শিশুকে প্রথম ৬ মাস বুকের দুধের বাইরে অন্য কিছু দিবেন না কেনো?
শিশুকে প্রথম ৬ মাস বুকের দুধের বাইরে অন্য কিছু না দেওয়ার কারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সংস্থাগুলি প্রথম ৬ মাসে শিশুকে শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য পরামর্শ দেয়। এর পেছনে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক এবং স্বাস্থ্যগত কারণ রয়েছে।
আসুন, বিস্তারিতভাবে জানি কেন শিশুকে প্রথম ৬ মাস শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত:
১. শিশুর পুষ্টির চাহিদা পূর্ণ করা
- প্রথম ৬ মাসে, শিশুর পুষ্টির সব প্রয়োজন মায়ের বুকের দুধ থেকেই পূর্ণ হয়। এতে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদান যেমন প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, মিনারেল এবং জলীয় উপাদান থাকে। বিশেষ করে কলস্ট্রাম, যা জন্মের পর প্রথম ৩-৪ দিনের মধ্যে উৎপাদিত হয়, এটি শিশুর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং তার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
২. শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
- বুকের দুধে শক্তিশালী অ্যান্টিবডি থাকে যা শিশুর শারীরিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করে। মায়ের দুধের এই অ্যান্টিবডি শিশুকে নানা ধরনের সংক্রমণ এবং রোগ থেকে রক্ষা করে। এই সময় শিশুর শারীরিক প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
- বিভিন্ন সংক্রমণ (যেমন ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, ইত্যাদি) থেকে শিশুকে রক্ষা করার জন্য বুকের দুধ অত্যন্ত কার্যকর।
৩. শিশুর পাচনতন্ত্রের জন্য উপকারী
- বুকের দুধ শিশুর পাচনতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। এটি সহজে হজম হয় এবং শিশুর পেটের উপর কোনো চাপ সৃষ্টি করে না। প্রথম ৬ মাসে, শিশুর পাচনতন্ত্র ঠিকমতো পরিপক্ক হয় না, তাই বুকের দুধের মতো সহজে হজমযোগ্য খাবার ছাড়া অন্য কিছু দেওয়া উচিত নয়। অন্য খাবার শিশুর পেটে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যেমন গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য, পেট ব্যথা ইত্যাদি।
৪. পুষ্টি সংকট এবং অপুষ্টির ঝুঁকি কমানো
- প্রথম ৬ মাসে শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর ফলে শিশুর অপুষ্টির ঝুঁকি অনেক কমে যায়। বিভিন্ন গবেষণা দেখিয়েছে যে যারা প্রথম ৬ মাসে শুধু বুকের দুধ খেয়েছে, তাদের পুষ্টির ঘাটতি বা শারীরিক সমস্যা যেমন কম ওজন, শারীরিক দুর্বলতা, ইত্যাদি কম হয়।
- অন্য খাবার (যেমন বাচ্চাদের জন্য তৈরি ফর্মুলা দুধ বা সলিড খাবার) পুষ্টির ঘাটতি বা অপ্রতুলতা সৃষ্টি করতে পারে, কারণ ফর্মুলা দুধ এবং সলিড খাবারে সেই পরিমাণ সঠিক পুষ্টি উপাদান থাকে না, যা শিশুর প্রথম ৬ মাসের জন্য প্রয়োজনীয়।
৫. শিশুর মানসিক ও আবেগিক উন্নয়ন
- বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় মায়ের সঙ্গে শিশুর মধ্যে একধরনের আবেগিক সম্পর্ক (bonding) তৈরি হয়। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে মা তার শিশুর সঙ্গে নিকট সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যা শিশুর মানসিক ও আবেগিক উন্নয়নে সহায়ক।
- এটি শিশুর শান্তি এবং নিরাপত্তা অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং তাকে ভালভাবে পরিপক্ক হতে সাহায্য করে। শিশু যখন তার মায়ের কাছ থেকে দুধ পায়, তখন তার মধ্যে নিরাপত্তার অনুভূতি তৈরি হয়, যা তার মানসিক স্বাস্থ্য এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
৬. শিশুর শারীরিক বিকাশ এবং শক্তির স্তর
- বুকের দুধ শিশুর শারীরিক বিকাশে সহায়ক। এটি শিশুর সঠিক শারীরিক বৃদ্ধি এবং মস্তিষ্কের বিকাশেও সাহায্য করে।
- এতে থাকা অলিকোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য অপরিহার্য এবং এটি স্নায়ুতন্ত্রের উন্নতিতে সহায়তা করে। অন্যান্য খাবার (যেমন সলিড খাবার বা ফর্মুলা দুধ) এই পুষ্টির স্তরটি পূরণ করতে পারে না।
৭. শিশুর অভ্যস্ততা এবং অ্যালার্জি প্রতিরোধ
- শিশুর বয়স ৬ মাস পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত, তার শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা পুরোপুরি বিকশিত হয় না। তাই, শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে শিশুকে অ্যালার্জি, ফুড সেনসিটিভিটি, বা অন্ত্রের সমস্যাগুলি থেকে সুরক্ষা দেওয়া যায়। যদি প্রথম ৬ মাসে শিশুকে অন্য খাবার দেওয়া হয়, তবে তার শরীরে অ্যালার্জি বা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
৮. বুকের দুধের কোয়ালিটি
- মায়ের বুকের দুধ সবসময় শিশুর বয়স এবং স্বাস্থ্য অনুযায়ী উপযুক্ত হয়। দুধের কোয়ালিটি বা গুণগত মান স্বাভাবিকভাবেই শিশুর চাহিদা অনুসারে পরিবর্তিত হয়, যাতে শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ হয়। যেমন, প্রথম কয়েক দিনের মধ্যে যে কলস্ট্রাম দুধ উৎপন্ন হয়, তা শিশুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৯. শিশুর আর্লি ডেভেলপমেন্ট (প্রাথমিক বিকাশ)
- প্রথম ৬ মাসে ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ থাকে। বুকের দুধের মধ্যে থাকা বিভিন্ন উপাদান শিশুর ব্রেইনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শিশু যখন বুকের দুধ খায়, তখন তার মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড এবং নিউট্রিয়েন্টস সরবরাহ হয়।
১০. প্রাকৃতিক গর্ভনিরোধক (Natural Contraceptive)
- মায়ের দুধ খাওয়ানোর কারণে মায়ের শরীরে প্রোল্যাকটিন হরমোনের মাত্রা বাড়ে, যা প্রাকৃতিকভাবে গর্ভধারণ প্রতিরোধ করতে সহায়ক হতে পারে। তবে, এটি শতভাগ নির্ভরযোগ্য গর্ভনিরোধক নয়, তবে এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করে।
১১. মায়ের স্বাস্থ্যের উপকারিতা
- ব্রেস্টফিডিং শুধুমাত্র শিশুর জন্য নয়, মায়ের জন্যও উপকারী। এটি মায়ের শরীরে প্রোল্যাকটিন ও অক্সিটোসিন হরমোনের নির্গমন বাড়ায়, যা মায়ের শরীরকে সুস্থ রাখতে এবং তার সন্তান জন্মের পর দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করে।
- বুকের দুধ খাওয়ানো মায়ের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।
১২. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) পরামর্শ
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং জাতিসংঘ শিশু তহবিল (UNICEF) বলেছে, শিশুকে প্রথম ৬ মাস শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত এবং এরপরও শিশুকে দুই বছর পর্যন্ত বুকের দুধের পাশাপাশি সলিড খাবার দেওয়া যেতে পারে।
উপসংহার: শিশুর প্রথম ৬ মাসের বুকের দুধ খাওয়ানো শুধুমাত্র তার শারীরিক এবং মানসিক উন্নয়নের জন্য নয়, বরং তার জীবনকালীন স্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বুকের দুধ শিশুকে পুষ্টি, রোগ প্রতিরোধ, সঠিক শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে সহায়তা করে। এটি মায়ের এবং শিশুর সম্পর্ক গঠনে, মা-শিশুর মধ্যে এক বন্ধন তৈরি করতে সহায়তা করে এবং শিশুর ভবিষ্যত স্বাস্থ্য সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।
সার্চ কী: প্রথম ৬ মাস
শিশুকে শুধু বুকের দুধ, শিশুকে ৬ মাসের আগে অন্য খাবার না
দেওয়ার কারণ, ৬ মাসের আগে কেন বাইরের খাবার দেয়া যাবে না,
শিশুর জন্য শুধুমাত্র বুকের দুধ কেন জরুরি, এক্সক্লুসিভ
ব্রেস্টফিডিং এর উপকারিতা, শিশুকে ৬ মাস বুকের দুধ দেওয়ার
গুরুত্ব, ৬ মাসের আগে পরিপূরক খাবার না দেওয়ার কারণ,
শিশুকে শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানোর উপকারিতা, বাচ্চাকে ৬ মাসের আগে পানি দেওয়া যাবে কি না, শিশুকে
অন্য খাবার দিলে কী ক্ষতি হয়, ৬ মাসের আগে শিশুর পাচনতন্ত্র
প্রস্তুত নয়, বুকের দুধের পুষ্টি গুণ, কেন শিশু খাদ্য নয় শুধু বুকের দুধ, বুকের দুধ ছাড়া
কিছু খাওয়ানো কি ক্ষতিকর, শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
বাড়াতে বুকের দুধ, ৬ মাস এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং, শিশুর জন্য ফর্মুলা মিল্ক খারাপ কি না
ঘোষণা: এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সকল লেখনি লেখক ও ওয়েব এডমিন মুহাম্মাদ আল-আমিন খান কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। Bangla Articles এর কোনো লেখনি থেকে সম্পূর্ণ অথবা আংশিক কপি করে সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্য কোনো ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা যাবে না। কোনো লেখনি ভালো লাগলে ও প্রয়োজনীয় মনে হলে এই ওয়েবসাইট থেকেই তা পড়তে পারেন অথবা ওয়েব লিংক শেয়ার করতে পারেন। গুগল সার্চ থেকে দেখা গেছে যে- বহু লেখনি কতিপয় ব্যক্তি নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন, যা সম্পূর্ণরূপে কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন। ভবিষ্যতে আবারও এমনটি হলে প্রথমত গুগলের কাছে রিপোর্ট করা হবে ও দ্বিতীয়ত তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কপিরাইট আইনের আওতায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সাথে সকলের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে- Bangla Articles এ প্রকাশিত কোনো লেখনি আপনার ভালো না-ও লাগতে পারে, প্রয়োজনে আপনি এর সমালোচনা কমেন্টের মাধ্যমে করতে পারেন। বাক স্বাধীনতা, চিন্তার বহিঃপ্রকাশ করার অধিকার ও লেখালেখি করার অভ্যাসের জায়গা থেকে লেখক যা ইচ্ছা তাই লিখতে পারেন। তবে তিনি তার যেকোনো লেখনির ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন যাতে করে শালীনতা বজায় রাখা যায় এবং অন্যের ধর্মীয় অনুভূতি, মূল্যবোধ ও অধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা যায়। - মুহাম্মাদ আল-আমিন খান, লেখক ও ওয়েব এডমিন, Bangla Articles