শিশুদের হাঁপানি রোগ পরিচিতি, লক্ষণ, কারণ, প্রতিরোধ,
প্রতিকার, চিকিৎসা, পরামর্শ
ও সতর্কতা
শিশুদের হাঁপানি রোগ: পরিচিতি
হাঁপানি (Asthma) একটি দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ, যা শ্বাসনালীতে প্রদাহ এবং সংকোচন সৃষ্টি করে। এতে শ্বাসনালী সঙ্কুচিত হয়ে
যায়, ফলে শ্বাস নিতে অসুবিধা হতে পারে এবং শ্বাসের গতি
বৃদ্ধি পায়। হাঁপানি একটি সাধারণ রোগ, যা শিশুদের মধ্যে বেশ
সাধারণ এবং যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তবে এটি
শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি, কাশি এবং
শ্বাসরোধের মতো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। হাঁপানি সাধারণত একটি উত্তেজক রোগ,
অর্থাৎ এটি সাধারণত বিভিন্ন পরিবেশগত বা জৈবিক উদ্দীপক দ্বারা
উত্তেজিত হতে পারে।
হাঁপানি রোগের লক্ষণ:
হাঁপানির প্রধান লক্ষণগুলি হল:
- শ্বাসকষ্ট:
হাঁপানির একটি সাধারণ লক্ষণ হল শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা। শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে অবরোধ বা সঙ্কুচন অনুভূত হতে পারে, যা শ্বাস নিতে কঠিন করে তোলে। এটি বিশেষ করে রাতে বা সকালে বেশি দেখা যায়। - খিঁচুনি বা সিঁটকি শব্দ (Wheezing):
হাঁপানির কারণে শ্বাসনালী সংকুচিত হলে শ্বাস নিতে সময় একটি সিঁটকি বা হুইজিং (Wheezing) শব্দ হতে পারে। এই শব্দ শ্বাস নেয়ার সময় শোনা যায়। - কাশি:
বিশেষ করে রাতে বা ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় হাঁপানির কারণে কাশি হতে পারে। কাশি সাধারণত শুকনো এবং দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। - বুকের চাপ বা অস্বস্তি:
শিশুর বুকের মধ্যে চাপ বা অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে, যা শ্বাস নিতে সমস্যা তৈরি করে। - শ্বাসের গতি বৃদ্ধি:
হাঁপানি আক্রমণের সময় শিশুর শ্বাসের গতি বৃদ্ধি পেতে পারে এবং বুকের পেশী শক্ত হতে পারে। - চকচকে শ্বাস বা উঁচু স্বরের শব্দ:
হাঁপানির আক্রমণে শিশুর শ্বাসে উঁচু বা চিকচিক শোনা যেতে পারে। - বিশ্রাম বা শিথিলতা:
হাঁপানির কারণে শিশু শ্বাস নিতে না পেরে ক্লান্ত বা দুর্বল অনুভব করতে পারে।
হাঁপানি রোগের কারণ:
শিশুদের হাঁপানির কারণগুলি বেশ কিছু
হতে পারে, এবং এটি পরিবেশগত, জৈবিক
এবং বৈশিষ্ট্যগত ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে:
- জিনগত কারণ:
হাঁপানি একটি পারিবারিক রোগ হতে পারে। যে শিশুদের পরিবারের কেউ হাঁপানি বা অ্যালার্জির সমস্যায় ভোগেন, তাদের হাঁপানির ঝুঁকি বেশি থাকে। - অ্যালার্জি:
ধুলা, পশুর লোম, পোলেন, ছত্রাক, এবং অন্য কোনো অ্যালার্জেন হাঁপানির আক্রমণকে উসকে দিতে পারে। - শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ:
ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার কারণে শ্বাসতন্ত্রে ইনফেকশন হলে হাঁপানির লক্ষণ বৃদ্ধি পেতে পারে। - শারীরিক পরিশ্রম:
অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম, বিশেষ করে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায়, হাঁপানির আক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে। - ধূমপান ও দূষিত বাতাস:
ধূমপান, পরিবেশগত দূষণ, রাসায়নিক বা তেলবাহী কেমিক্যালের সংস্পর্শে আসলে হাঁপানি হতে পারে। - তাপমাত্রা পরিবর্তন:
খুব গরম বা খুব ঠাণ্ডা পরিবেশও হাঁপানির লক্ষণকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
হাঁপানি প্রতিরোধ:
হাঁপানি পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য নয়, তবে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এর প্রতিরোধের জন্য কিছু উপায়
রয়েছে:
- অ্যালার্জেন থেকে দূরে রাখা:
শিশুকে অ্যালার্জির কারণ থেকে দূরে রাখতে হবে। যেমন, ধুলা, পশু, পোলেন ইত্যাদি। ঘরটিকে পরিষ্কার রাখুন এবং নিয়মিত গালিচা, বিছানা ও পর্দা ধুতে হবে। - ধূমপান মুক্ত পরিবেশ:
শিশুকে ধূমপান মুক্ত পরিবেশে রাখতে হবে। ধূমপান হাঁপানি বাড়িয়ে দিতে পারে। - টিকা গ্রহণ:
শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বা ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা নেওয়া শিশুর হাঁপানি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে। - নিয়মিত চিকিৎসা পরীক্ষা:
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে নিয়মিত পরীক্ষা এবং মেডিকেশন অনুসরণ করলে হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। - শারীরিক পরিশ্রমের আগে সতর্কতা:
ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় বা শারীরিক পরিশ্রমের সময় হাঁপানি আক্রমণের ঝুঁকি বাড়তে পারে, তাই এমন পরিস্থিতিতে সতর্ক থাকতে হবে।
হাঁপানি রোগের প্রতিকার:
- ইনহেলার (Inhaler):
হাঁপানি রোগীদের জন্য সবচেয়ে সাধারণ চিকিৎসা হলো ইনহেলার ব্যবহার। এটি শ্বাসনালীতে সরাসরি ওষুধ পৌঁছায় এবং দ্রুত সঙ্কোচন কমাতে সাহায্য করে। - ব্রঙ্কোডায়লেটর (Bronchodilators):
এই ওষুধগুলি শ্বাসনালীকে প্রসারিত করে এবং শ্বাস নিতে সহজ করে তোলে। এটি হাঁপানি আক্রান্ত রোগীদের শ্বাসের অবস্থা স্বাভাবিক করে। - স্টেরয়েড ইনহেলার:
হাঁপানির প্রদাহ কমাতে এবং শ্বাসনালীকে শান্ত করতে স্টেরয়েড ইনহেলার দেওয়া যেতে পারে। - লং-অ্যাকটিং ব্রঙ্কোডায়লেটর:
যদি ইনহেলার স্বাভাবিকভাবে কাজ না করে, তবে চিকিৎসক লং-অ্যাকটিং ব্রঙ্কোডায়লেটর বা স্টেরয়েড ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন। - মৌখিক স্টেরয়েড:
গুরুতর হাঁপানি আক্রমণ হলে চিকিৎসক মৌখিক স্টেরয়েড (যেমন, প্রেডনিসোলন) ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন, যা দ্রুত প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। - অ্যালার্জি চিকিৎসা:
হাঁপানি যদি অ্যালার্জি দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়ে থাকে, তবে অ্যান্টিহিস্টামিন বা অ্যালার্জি ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে।
হাঁপানি চিকিৎসা:
- ইনহেলার এবং নেবুলাইজার (Nebulizer):
হাঁপানি রোগীদের জন্য ইনহেলার বা নেবুলাইজার ব্যবহারের মাধ্যমে মেডিসিন শ্বাসের মাধ্যমে প্রবাহিত করা হয়। এটি শ্বাসনালীতে সরাসরি কাজ করে। - মেডিক্যাল মনিটরিং:
হাঁপানি রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসক দ্বারা মনিটরিং করা উচিত। তারা চিকিৎসার পরামর্শ এবং প্রয়োজনীয় মেডিকেশন পরিবর্তন করতে পারেন। - শ্বাস প্রশ্বাসের প্রশিক্ষণ:
হাঁপানি রোগীদের শ্বাস প্রশ্বাসের কিছু সহজ কৌশল শেখানো যেতে পারে, যা তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।
হাঁপানি রোগের পরামর্শ:
- বের হওয়ার আগে শ্বাস নিন:
হাঁপানি আক্রান্ত শিশুকে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় বা ধূলিময় জায়গায় যাওয়ার আগে সতর্ক হতে হবে। এবং প্রয়োজনে ইনহেলার সঙ্গে নিতে হবে। - নিয়মিত চিকিৎসক পরামর্শ:
হাঁপানি দীর্ঘমেয়াদী রোগ হতে পারে, তাই নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং চিকিৎসা তদারকি করা উচিত। - অ্যালার্জি পরীক্ষা:
হাঁপানি যদি অ্যালার্জি কারণে হয়ে থাকে, তবে অ্যালার্জির পরীক্ষা করা যেতে পারে এবং অ্যালার্জির কারণ চিহ্নিত করে তা থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করা উচিত।
হাঁপানি সতর্কতা:
- হাঁপানির লক্ষণ প্রথমে শনাক্ত করুন:
যদি শিশুর হাঁপানির লক্ষণ দেখা দেয়, তবে তা দ্রুত শনাক্ত করুন এবং চিকিৎসকের কাছে দ্রুত পরামর্শ নিন। - এলার্জেন এবং ধূমপান থেকে দূরে রাখা:
শিশুকে এলার্জেন এবং ধূমপান মুক্ত পরিবেশে রাখুন। এটা হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে। - হাঁপানি আক্রমণ হলে দ্রুত চিকিৎসা:
হাঁপানি আক্রমণ হলে দ্রুত ইনহেলার বা অন্যান্য প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিতে হবে। - শারীরিক পরিশ্রমের আগে সতর্কতা:
ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় বা শারীরিক পরিশ্রমের সময় শ্বাসকষ্ট বৃদ্ধির ঝুঁকি থাকতে পারে, তাই এ ধরনের পরিস্থিতিতে সতর্কতা অবলম্বন করুন।
উপসংহার:
শিশুদের হাঁপানি একটি সাধারণ কিন্তু
গুরুতর শ্বাসতন্ত্রের রোগ, যা সঠিক চিকিৎসা এবং
নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। শিশুকে অ্যালার্জেন, দূষণ ও ধূমপান থেকে দূরে রাখার পাশাপাশি নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে
হাঁপানি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
ঘোষণা: এই ওয়েবসাইটে (Bangla Articles) প্রকাশিত সকল লেখনি লেখক ও ওয়েব এডমিন মুহাম্মাদ আল-আমিন খান কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। Bangla Articles এর কোনো লেখনি থেকে সম্পূর্ণ অথবা আংশিক কপি করে সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্য কোনো ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা যাবে না। কোনো লেখনি ভালো লাগলে ও প্রয়োজনীয় মনে হলে এই ওয়েবসাইট থেকেই তা পড়তে পারেন অথবা ওয়েব লিংক শেয়ার করতে পারেন। গুগল সার্চ থেকে দেখা গেছে যে- বহু লেখনি কতিপয় দুষ্কৃতিকারী নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন, যা সম্পূর্ণরূপে কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন। ভবিষ্যতে আবারও এমনটি হলে প্রথমত গুগলের কাছে রিপোর্ট করা হবে ও দ্বিতীয়ত তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কপিরাইট আইনের আওতায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সাথে সকলের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে- Bangla Articles এ প্রকাশিত কোনো লেখনি আপনার ভালো না-ও লাগতে পারে, প্রয়োজনে আপনি এর সমালোচনা কমেন্টের মাধ্যমে করতে পারেন। বাক স্বাধীনতা, চিন্তার বহিঃপ্রকাশ করার অধিকার ও লেখালেখি করার অভ্যাসের জায়গা থেকে লেখক যা ইচ্ছা তাই লিখতে পারেন। তবে তিনি তার যেকোনো লেখনির ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন যাতে করে শালীনতা বজায় রাখা যায় এবং অন্যের ধর্মীয় অনুভূতি, মূল্যবোধ ও অধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা যায়। - মুহাম্মাদ আল-আমিন খান, লেখক ও ওয়েব এডমিন, Bangla Articles