শিশুদের ম্যালেরিয়া রোগ পরিচিতি, লক্ষণ, কারণ, প্রতিরোধ,
প্রতিকার, চিকিৎসা, পরামর্শ
ও সতর্কতা
শিশুদের ম্যালেরিয়া রোগ: পরিচিতি
ম্যালেরিয়া একটি গুরুতর পরজীবী সংক্রমণ, যা সাধারণত
মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এটি প্লাজমোডিয়াম নামক পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট হয়, যা মশার কামড়ের মাধ্যমে শরীরে প্রবাহিত হয়। ম্যালেরিয়া শিশুদের মধ্যে এক
ধরনের জীবনসংহারী রোগ হতে পারে, বিশেষত যেখানে স্বাস্থ্য
সেবা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাব রয়েছে। তবে সময়মতো চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের
মাধ্যমে এটি সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
ম্যালেরিয়ার লক্ষণ:
ম্যালেরিয়ার লক্ষণ সাধারণত ৭ থেকে ৩০
দিন পর প্রদর্শিত হতে শুরু করে, তবে এর সময়কাল
শিশু ও পরিপক্ক ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন হতে পারে। কিছু সাধারণ লক্ষণ হল:
- জ্বর:
ম্যালেরিয়ার সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো তীব্র জ্বর, যা একসময় শীতলতা এবং ঘাম দিয়ে চলে আসে। জ্বরের তীব্রতা প্রায়ই দিনের নির্দিষ্ট সময়ে বৃদ্ধি পায় এবং তারপর স্বাভাবিক হয়ে যায়। - শরীরে ব্যথা:
ম্যালেরিয়া আক্রান্ত শিশুদের শরীরে বিশেষ করে হাড়ে ব্যথা অনুভূত হয়। কিছু ক্ষেত্রে মাংসপেশীতেও ব্যথা হতে পারে। - শ্বাসকষ্ট এবং ঠাণ্ডা লাগা:
শ্বাস নিতে সমস্যা হতে পারে, এবং অনেক সময় শিশু শ্বাসকষ্ট, হালকা কাশি বা ঠাণ্ডার মতো উপসর্গ প্রদর্শন করতে পারে। - বমি ও পেটের ব্যথা:
ম্যালেরিয়ার কারণে শিশুদের মাঝে বমি, ডায়রিয়া বা পেটের ব্যথা হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে ক্ষুধামন্দা দেখা দিতে পারে। - অসুস্থতা বা অজ্ঞান হওয়া:
গুরুতর ম্যালেরিয়া আক্রান্ত শিশু অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে বা অত্যধিক দুর্বলতায় ভোগে। - ত্বকে হলুদ ভাব (জন্ডিস):
ম্যালেরিয়া পরবর্তী সময়ে শিশুদের ত্বকে হলুদ ভাব দেখা দিতে পারে, যা লিভারের ক্ষতির কারণে হয়। - বিভ্রান্তি বা স্নায়বিক সমস্যা:
গুরুতর ম্যালেরিয়া আক্রান্ত শিশুর মাঝে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা বা স্নায়বিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ম্যালেরিয়ার কারণ:
ম্যালেরিয়া একটি পরজীবী সংক্রমণ, যা প্লাজমোডিয়াম (Plasmodium) নামক
পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট। এই পরজীবী মূলত আনোফিলিস মশা (Anopheles
mosquito) দ্বারা ছড়ায়। যখন মশা কাউকে কামড়ায়, তখন এটি ম্যালেরিয়ার পরজীবী মানুষের শরীরে প্রবাহিত করে এবং রোগের সৃষ্টি
করে।
ম্যালেরিয়ার প্রকার:
১. Plasmodium falciparum:
এটি ম্যালেরিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক ধরনের পরজীবী এবং এটি দ্রুত এবং
গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করতে পারে।
২. Plasmodium vivax:
এই ধরনের ম্যালেরিয়া সাধারণত কম গুরুতর হয়, তবে
এটি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে।
৩. Plasmodium malariae এবং Plasmodium ovale:
এই প্রকারের ম্যালেরিয়া তুলনামূলকভাবে কম গুরুতর হয়, তবে এগুলোও চিকিৎসা না করা হলে বিপজ্জনক হতে পারে।
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ:
১. মশারি ও মশার কামড় থেকে রক্ষা:
- মশারি ব্যবহার করা
উচিত, বিশেষ করে রাতে যখন মশা
বেশি থাকে। মশারির মধ্যে ইনসেকটিসাইড যুক্ত করা আরও কার্যকর।
- মশার প্রতিরোধক স্প্রে বা ক্রিম (যেমন DEET) ব্যবহার
করা উচিত।
২. মশার কামড় থেকে बचতে সতর্কতা:
- দিনের বেলায়ও মশা কামড়াতে পারে, তাই মশারি বা মশা তাড়ানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
- ঘরের জানালা বা দরজা বন্ধ রেখে সুরক্ষিত থাকতে হবে।
৩. পরিষ্কার পরিবেশ:
- মশা প্রজনন স্থান দূর করতে বাড়ির আশেপাশের জলাশয়, পাত্র বা কাঁদাপানি পরিষ্কার রাখতে হবে।
৪. টিকা:
- বর্তমানে কিছু দেশে ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে টিকার
পরীক্ষা চলছে, তবে যেহেতু এটি
একটি কার্যকরী টিকা নয়, তাই অন্যান্য প্রতিরোধমূলক
ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত।
৫. প্রতিরোধক ওষুধ:
- যদি কোনও শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ম্যালেরিয়া
প্রবণ এলাকায় থাকে, তবে চিকিৎসকরা
কখনও কখনও প্রতিরোধক অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ওষুধ (যেমন
চাইক্লোকুইন) দেন, যা
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সহায়তা করে।
ম্যালেরিয়া প্রতিকার ও চিকিৎসা:
১. অ্যান্টিম্যালেরিয়াল চিকিৎসা:
- ম্যালেরিয়া আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিম্যালেরিয়াল
ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এগুলোর মধ্যে কুইনিন, আর্তেমিসিনিন, চাইক্লোকুইন,
মেফ্লোকুইন, এবং লুমেফান্ট্রিন
ইত্যাদি অন্যতম।
- সাধারণত, ম্যালেরিয়ার ধরন অনুযায়ী চিকিৎসক যে ওষুধ প্রদান করবেন তা নির্ভর
করে।
২. অক্সিজেন থেরাপি:
- গুরুতর ম্যালেরিয়া আক্রান্ত শিশুর জন্য অক্সিজেন
প্রদান করা হতে পারে, বিশেষ করে
শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকলে।
৩. আইভি তরল এবং সাপোর্টিভ কেয়ার:
- ম্যালেরিয়া আক্রান্ত শিশুদের আইভি তরল (ইন্ট্রাভেনাস তরল) প্রয়োগ করা হতে পারে, যাতে তারা ডিহাইড্রেশন বা শরীরের পুষ্টির অভাব থেকে রক্ষা পায়।
৪. পাশাপাশি অন্যান্য চিকিত্সা:
- যদি ম্যালেরিয়া সংক্রমণ গুরুতর হয়ে যায় এবং অন্যান্য
অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে
বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে আরও উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে।
ম্যালেরিয়া চিকিৎসা:
- ম্যালেরিয়া নিরাময়ের জন্য অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ওষুধের
একটি কোর্স অনুসরণ করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের প্লাজমোডিয়াম পরজীবীকে পরাস্ত
করার জন্য একাধিক ওষুধ ব্যবহৃত হতে পারে।
- চিকিৎসক যখন রোগ নির্ধারণ করেন, তখন জ্বর পরিমাপ, রক্ত
পরীক্ষা, এবং প্লাজমোডিয়াম পরীক্ষা করা হয়।
ম্যালেরিয়া রোগের পরামর্শ ও সতর্কতা:
১. শিশুর অবস্থার অবজার্ভেশন:
- শিশুদের ম্যালেরিয়া উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের
কাছে নিয়ে যেতে হবে। জ্বর, দুর্বলতা,
বমি বা শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসা গ্রহণ করুন।
২. পুনরায় সংক্রমণ প্রতিরোধ:
- একবার ম্যালেরিয়া চিকিৎসা শেষ হলে, পুনরায় সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকলে যত দ্রুত সম্ভব
চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- স্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা:
- শিশুদের ম্যালেরিয়া সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পরিষ্কার
ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখা উচিত। ঘরের আশেপাশে জলাশয় না থাকা, মশারি ব্যবহারের মাধ্যমে মশার কামড়
থেকে বাঁচানো যাবে।
উপসংহার:
ম্যালেরিয়া একটি প্রাণঘাতী রোগ হতে
পারে, তবে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা এবং প্রতিরোধমূলক
ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এটি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ
যত্ন নেওয়া উচিত, কারণ তাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম
থাকে। ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সঠিক সচেতনতা, টিকা, এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ঘোষণা: এই ওয়েবসাইটে (Bangla Articles) প্রকাশিত সকল লেখনি লেখক ও ওয়েব এডমিন মুহাম্মাদ আল-আমিন খান কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। Bangla Articles এর কোনো লেখনি থেকে সম্পূর্ণ অথবা আংশিক কপি করে সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্য কোনো ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা যাবে না। কোনো লেখনি ভালো লাগলে ও প্রয়োজনীয় মনে হলে এই ওয়েবসাইট থেকেই তা পড়তে পারেন অথবা ওয়েব লিংক শেয়ার করতে পারেন। গুগল সার্চ থেকে দেখা গেছে যে- বহু লেখনি কতিপয় দুষ্কৃতিকারী নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন, যা সম্পূর্ণরূপে কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন। ভবিষ্যতে আবারও এমনটি হলে প্রথমত গুগলের কাছে রিপোর্ট করা হবে ও দ্বিতীয়ত তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কপিরাইট আইনের আওতায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সাথে সকলের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে- Bangla Articles এ প্রকাশিত কোনো লেখনি আপনার ভালো না-ও লাগতে পারে, প্রয়োজনে আপনি এর সমালোচনা কমেন্টের মাধ্যমে করতে পারেন। বাক স্বাধীনতা, চিন্তার বহিঃপ্রকাশ করার অধিকার ও লেখালেখি করার অভ্যাসের জায়গা থেকে লেখক যা ইচ্ছা তাই লিখতে পারেন। তবে তিনি তার যেকোনো লেখনির ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন যাতে করে শালীনতা বজায় রাখা যায় এবং অন্যের ধর্মীয় অনুভূতি, মূল্যবোধ ও অধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা যায়। - মুহাম্মাদ আল-আমিন খান, লেখক ও ওয়েব এডমিন, Bangla Articles