শিশুদের নিউমোনিয়ার লক্ষণ, চিকিৎসা ও সতর্কতা

Muhammad Al-Amin Khan, Editor in Chief of BA, BJN, BST
0


শিশুদের নিউমোনিয়া রোগ: পরিচিতি

নিউমোনিয়া হল এক ধরনের শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, যা সাধারণত ফুসফুসের অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি করে। নিউমোনিয়া মূলত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, অথবা ফাঙ্গাসের সংক্রমণের কারণে হতে পারে এবং এটি শিশুদের মধ্যে খুবই সাধারণ, তবে তা অনেকসময় গুরুতরও হতে পারে। শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া আক্রান্ত হলে শ্বাসকষ্ট, জ্বর, এবং কাশির মতো লক্ষণ দেখা দেয়।

নিউমোনিয়া প্রাথমিকভাবে ফুসফুসের অ্যালভিওলি (alveoli) নামক ক্ষুদ্র বাতাসের বুদবুদের মধ্যে প্রদাহ সৃষ্টি করে, যার ফলে অক্সিজেন শোষণ কমে যায় এবং শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এটি যদি দ্রুত চিকিৎসা না করা হয়, তবে জীবনহানির ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

নিউমোনিয়ার লক্ষণ:

শিশুদের নিউমোনিয়ার লক্ষণ বয়স অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে। তবে সাধারণ কিছু লক্ষণ হল:

  1. জ্বর:
    নিউমোনিয়া হলে শিশুর শরীরে জ্বর হতে পারে। এটি সাধারণত ১০০-১০৪
    °F (৩৭.৭-৪০°C) পর্যন্ত ওঠে।
  2. শ্বাসকষ্ট:
    শিশুর শ্বাসকষ্ট হতে পারে। শিশুর বুকের পেশী খুব কঠিনভাবে কাজ করতে দেখা যেতে পারে, এবং তারা দ্রুত বা গভীরভাবে শ্বাস নেয়।
  3. কাশি:
    প্রাথমিকভাবে শুকনো কাশি বা তরল কাশি হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, কাশির সাথে সাদা, হলুদ বা সবুজ রংয়ের শ্বাসনালির ক্ষরণ (ফ্লাম) দেখা যেতে পারে।
  4. চিনচিনে বা বুকের ব্যথা:
    শিশুর বুকের দিকে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে, বিশেষত শ্বাস নেওয়ার সময়।
  5. শরীরের ক্লান্তি বা দুর্বলতা:
    নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুর শরীর দুর্বল হতে পারে এবং সে সাধারণত অনেক ক্লান্ত অনুভব করতে পারে।
  6. খাবার খেতে আগ্রহ কমে যাওয়া:
    শিশুদের অরুচি বা খাবার খেতে ইচ্ছা না হওয়া একটি সাধারণ লক্ষণ হতে পারে।
  7. বিকৃত শ্বাসের শব্দ:
    শ্বাসের সঙ্গে শব্দ হতে পারে, যা অ্যাজমা বা ব্রঙ্কাইটিসের মতো শ্বাসনালী সমস্যায় সাধারণ। এটি অনেক সময় "উচ্চ স্বরে শ্বাস" অথবা "গড়গড় শব্দ" হিসেবে পরিচিত।
  8. বদলে যাওয়া আচরণ:
    শিশু বেশি ঘুমিয়ে থাকতে পারে, বা অস্বাভাবিকভাবে বিরক্ত বা উদাসীন হয়ে উঠতে পারে।

নিউমোনিয়ার কারণ:

শিশুদের নিউমোনিয়া বিভিন্ন কারণে হতে পারে, তবে এর প্রধান কারণগুলি হল:

  1. ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন:
    শিশুদের নিউমোনিয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া, বিশেষ করে স্ট্রেপ্টোকোক্কাস নিউমোনিয়া (Streptococcus pneumoniae) এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা (Haemophilus influenzae) ব্যাকটেরিয়া। এর পাশাপাশি মাইকোপ্লাজমা (Mycoplasma pneumoniae) ব্যাকটেরিয়া ও নিউমোনিয়ার কারণ হতে পারে।
  2. ভাইরাল ইনফেকশন:
    ভাইরাল নিউমোনিয়া শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এটি সাধারণত ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, RSV (Respiratory Syncytial Virus), অ্যাডেনোভাইরাস, রাইনোভাইরাস বা করোনা ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হতে পারে।
  3. ফাঙ্গাস বা মাইক্রোবিয়াল সংক্রমণ:
    কিছু ক্ষেত্রে, ফাঙ্গাস (যেমন ক্যান্ডিডা বা অ্যাসপারগিলাস) বা অন্যান্য মাইক্রোবিয়াল সংক্রমণও নিউমোনিয়ার কারণ হতে পারে, তবে এটি খুব কম ক্ষেত্রে ঘটে।
  4. ধূমপান বা পরিবেশগত কারণে সংক্রমণ:
    ধূমপান বা দূষিত বাতাসের মধ্যে দীর্ঘকাল অবস্থান করলে ফুসফুসের সংক্রমণ এবং নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

নিউমোনিয়ার প্রতিরোধ:

  1. টিকা প্রদান:
    নিউমোনিয়া প্রতিরোধের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিকা রয়েছে। শিশুদের পৃথকী নিউমোনিয়া টিকা (Pneumococcal Vaccine) এবং হিব টিকা (Haemophilus influenzae type b vaccine) দেওয়া উচিত। এছাড়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা বা রোটাভাইরাস টিকাও কার্যকর হতে পারে।
  2. শ্বাসনালির যত্ন:
    শিশুকে ঠাণ্ডা বা গরম বাতাসের সংস্পর্শে আনা এড়িয়ে চলুন। ঠাণ্ডা বা গরম আবহাওয়া শ্বাসনালির রোগ তৈরি করতে পারে।
  3. হাত ধোয়ার অভ্যাস:
    শিশুদের নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন, বিশেষ করে খাবার খাওয়ার আগে এবং শৌচাগার ব্যবহারের পর।
  4. পরিষ্কার এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ:
    শিশুকে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখতে হবে। ধূমপান, দূষণ, এবং অপরিষ্কার পরিবেশে থাকলে নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  5. বুকের পেশীর ব্যায়াম:
    শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যকর পুষ্টি এবং পর্যাপ্ত পানি খাওয়ানোর মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করা।

নিউমোনিয়ার প্রতিকার:

  1. অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি:
    যদি নিউমোনিয়া ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে হয়, তবে ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারেন। এটা নিউমোনিয়ার গুরুতরতা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
  2. ভাইরাল নিউমোনিয়ার চিকিৎসা:
    ভাইরাল নিউমোনিয়া হলে, সাধারণত অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ প্রয়োগ করা হয় না, তবে পিরাসিটামল বা ইবুপ্রোফেন দিয়ে জ্বর এবং ব্যথা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
  3. অক্সিজেন থেরাপি:
    যদি শিশু শ্বাস নিতে অসুবিধা অনুভব করে, তাকে অক্সিজেন দেওয়া হতে পারে।
  4. হাসপাতাল ভর্তি:
    গুরুতর নিউমোনিয়া হলে শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হতে পারে, যেখানে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হবে।
  5. ব্রঙ্কোডায়লেটর ওষুধ:
    কিছু ক্ষেত্রে, ব্রঙ্কোডায়লেটর ওষুধের মাধ্যমে শ্বাসকষ্ট কমানোর চেষ্টা করা হয়।

নিউমোনিয়ার চিকিৎসা:

  1. অ্যান্টিবায়োটিক (ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের জন্য):
    চিকিৎসক ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়ার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক (যেমন, অমোক্সিসিলিন বা সেফট্রিয়াক্সন) ব্যবহার করতে পারেন।
  2. ভাইরাল নিউমোনিয়া:
    ভাইরাল নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে, অ্যান্টিভাইরাল ঔষধের প্রয়োগ করা হয় না, তবে চিকিৎসক শিশুর জ্বর এবং অন্যান্য লক্ষণগুলি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্যারাসিটামল বা ইবুপ্রোফেন পরামর্শ দিতে পারেন।
  3. ওষুধের পাশাপাশি বিশ্রাম:
    শিশুকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং তরল খাবার (জল, স্যুপ, ইত্যাদি) দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি সুস্থ হওয়ার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে।

নিউমোনিয়ার পরামর্শ:

  1. স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখা:
    শিশুকে পরিষ্কার এবং বায়ু চলাচলের পরিবেশে রাখতে হবে।
  2. রেগুলার ভ্যাকসিনেশন:
    শিশুর নিয়মিত টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করুন, যাতে ভাইরাল এবং ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়ার ঝুঁকি কমে যায়।
  3. খাবারের প্রতি আগ্রহ:
    শিশুকে পুষ্টিকর খাবার দেওয়া, যাতে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী থাকে।
  4. ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া:
    যদি শিশুর নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলি গুরুতর হয়, দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। শ্বাসকষ্ট, তীব্র জ্বর, এবং অতিরিক্ত ক্লান্তি হলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।

নিউমোনিয়ার সতর্কতা:

  1. প্রাথমিক লক্ষণ বুঝতে পারা:
    শিশুর শ্বাসকষ্ট, কাশি, এবং জ্বরের লক্ষণগুলি বুঝতে পারলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করুন।
  2. খাবার ও তরল খাবার:
    শিশুকে প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার এবং পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে, যাতে শরীর সুস্থ থাকে।
  3. অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা:
    যদি শিশু শ্বাসকষ্ট অনুভব করে, তাৎক্ষণিকভাবে অক্সিজেন সরবরাহ করুন এবং চিকিৎসকের কাছে দ্রুত পৌঁছান।

উপসংহার:

শিশুদের নিউমোনিয়া একটি গুরুতর শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ যা দ্রুত চিকিৎসা না করা হলে মারাত্মক হতে পারে। তবে এটি প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসাযোগ্য। শিশুদের টিকা, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখা, এবং প্রাথমিক লক্ষণগুলির প্রতি সতর্ক নজর রাখলে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি অনেকটা কমানো সম্ভব।

ঘোষণা: এই ওয়েবসাইটে (Bangla Articles) প্রকাশিত সকল লেখনি লেখক ও ওয়েব এডমিন মুহাম্মাদ আল-আমিন খান কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। Bangla Articles এর কোনো লেখনি থেকে সম্পূর্ণ অথবা আংশিক কপি করে সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্য কোনো ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা যাবে না। কোনো লেখনি ভালো লাগলে ও প্রয়োজনীয় মনে হলে এই ওয়েবসাইট থেকেই তা পড়তে পারেন অথবা ওয়েব লিংক শেয়ার করতে পারেন। গুগল সার্চ থেকে দেখা গেছে যে- বহু লেখনি কতিপয় দুষ্কৃতিকারী নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন, যা সম্পূর্ণরূপে কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন। ভবিষ্যতে আবারও এমনটি হলে প্রথমত গুগলের কাছে রিপোর্ট করা হবে ও দ্বিতীয়ত তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কপিরাইট আইনের আওতায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সাথে সকলের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে- Bangla Articles এ প্রকাশিত কোনো লেখনি আপনার ভালো না-ও লাগতে পারে, প্রয়োজনে আপনি এর সমালোচনা কমেন্টের মাধ্যমে করতে পারেন। বাক স্বাধীনতা, চিন্তার বহিঃপ্রকাশ করার অধিকার ও লেখালেখি করার অভ্যাসের জায়গা থেকে লেখক যা ইচ্ছা তাই লিখতে পারেন। তবে তিনি তার যেকোনো লেখনির ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন যাতে করে শালীনতা বজায় রাখা যায় এবং অন্যের ধর্মীয় অনুভূতি, মূল্যবোধ ও অধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা যায়। - মুহাম্মাদ আল-আমিন খান, লেখক ও ওয়েব এডমিন, Bangla Articles

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)
To Top