শিশুদের লিমফাটিক ফিল্যারিয়াসিস রোগ পরিচিতি, লক্ষণ, কারণ, প্রতিরোধ,
প্রতিকার, চিকিৎসা, পরামর্শ
ও সতর্কতা
শিশুদের লিমফাটিক ফিল্যারিয়াসিস রোগ:
পরিচিতি
লিমফাটিক ফিল্যারিয়াসিস (Lymphatic Filariasis), যা সাধারণত ফিলেরিয়াসিস বা হলাও
ডিস্ট্রিবিউটেড ফিলারিয়া হিসেবে পরিচিত, একটি প্যারাসিটিক
রোগ যা ফিলারিয়াল পরজীবী (Filarial parasites) দ্বারা
সৃষ্ট। এটি মূলত লিম্ফ সিস্টেম (lymphatic system)-কে
আক্রান্ত করে, যা শরীরের প্রতিরোধী ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ
অংশ। এই রোগটি মশা (Mosquito) দ্বারা বাহিত হয় এবং
এটি শিশুদের মধ্যে উন্নত পর্যায়ে পৌঁছালে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে,
যেমন এডিমা (Edema) এবং লিম্ফাটিক
ডিস্টেনশন (Lymphatic distension)। এই রোগের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো এটি শিশুদের
মস্তিষ্ক, হাত বা পায়ে স্থায়ী বিকৃতি তৈরি করতে পারে,
যা লিম্ফ্যাটিক ফিলিয়ারিয়াসিসের ডিপ্লোপডল বা হাত-পায়ের কুঁজো
হওয়ার সমস্যা (Elephantiasis) সৃষ্টি করতে পারে। তবে,
এটি সঠিক চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে
নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
লিমফাটিক ফিল্যারিয়াসিস রোগের লক্ষণ:
লিমফাটিক ফিল্যারিয়াসিসের লক্ষণ
সাধারণত ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। কিছু সাধারণ লক্ষণ:
- জ্বর এবং শীতলতা:
ফিলেরিয়াসিসের প্রাথমিক পর্যায়ে জ্বর, শীতলতা এবং শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। - লিম্ফ নোডের স্ফীতি (Swollen lymph nodes):
লিম্ফ নোডে স্ফীতি হতে পারে, যা গলায়, হাত বা পায়ের নিচে দেখা দিতে পারে। - লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের প্রদাহ:
আক্রান্ত শিশুর লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমে প্রদাহ হতে পারে, যা শারীরিক অস্বস্তি সৃষ্টি করে। - পায়ে বা হাতের ফোলাভাব (Elephantiasis):
দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ অথবা পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে, আক্রান্ত শিশুদের পায়ে বা হাতের ফোলাভাব এবং কুঁজো হওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটি ফিলিয়ারিয়ার উন্নত পর্যায়ের একটি লক্ষণ। - মাথাব্যথা এবং ক্লান্তি:
আক্রান্ত শিশুর মধ্যে মাথাব্যথা এবং অতিরিক্ত ক্লান্তি দেখা দিতে পারে। - শ্বাসকষ্ট বা কাশি:
কখনও কখনও শ্বাসকষ্ট বা কাশি হতে পারে, যা ফিলিয়ারিয়ার কারণে হতে পারে।
লিমফাটিক ফিল্যারিয়াসিসের কারণ:
লিমফাটিক ফিল্যারিয়াসিস ফিলারিয়াল
পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট, যা ওসক্রা
কেরকোর্টা (Wuchereria bancrofti), ব্রুচেলিয়া
ম্যালেই (Brugia malayi) এবং ব্রুজিয়া টিমোরি
(Brugia timori) হতে পারে। এই পরজীবীগুলি এডিস মশা
(Aedes mosquito), আনফিলেস মশা (Anopheles mosquito) এবং কিউলেক্স মশা (Culex mosquito) দ্বারা
পরিবাহিত হয়।
এডিস মশা যখন একজন ফিলিয়ারিয়ায়
আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত পান করে, তখন পরজীবী
লার্ভা মশার শরীরে প্রবাহিত হয়। তারপর, এই মশা যদি অন্য কোনো
ব্যক্তিকে কামড়ায়, তাহলে পরজীবী সেই ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ
করে এবং লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত ব্যক্তি মূলত মশার
কামড়ের মাধ্যমে এ রোগে সংক্রমিত হয়।
লিমফাটিক ফিল্যারিয়াসিসের প্রতিরোধ:
- মশা প্রতিরোধে ব্যবস্থা:
মশার কামড় থেকে বাঁচতে মশারি ব্যবহার, মশাবিরোধী স্প্রে ব্যবহার এবং মশার প্রজননস্থল পরিষ্কার রাখা জরুরি। বাড়ির আশেপাশে জল জমে থাকা স্থানে মশার প্রজনন হতে পারে, তাই জলাবদ্ধতা রোধ করা উচিত। - অ্যান্টিফিলারিয়াল ড্রাগের প্রয়োগ:
বিশেষ কিছু ড্রাগ যেমন ডিক্লোরোভার (Diethylcarbamazine) বা মেবেনডাজল (Mebendazole) ব্যবহার করা যেতে পারে, যা ফিলারিয়াসিসের সংক্রমণ রোধে কার্যকরী। - পিপল হেলথ ক্যাম্পেইন:
স্থানীয় স্বাস্থ্য অধিকারী এবং প্রশাসনকে সচেতন করে তোলা উচিত, যাতে তারা লোকজনকে মশার কামড় থেকে বাঁচানোর জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করে। - শিশুদের জন্য টিকাদান:
বিভিন্ন এলাকাতে ফিলিয়ারিয়াসিসের টিকা প্রদান ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যা মশাবাহিত রোগের সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করে। - মশাবিরোধী ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার:
মশাবিরোধী ক্রিম বা স্প্রে শিশুর ত্বকে ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে সেগুলি শিশুদের জন্য নিরাপদ কিনা, তা নিশ্চিত হতে হবে।
লিমফাটিক ফিল্যারিয়াসিসের প্রতিকার ও
চিকিৎসা:
ফিলিয়ারিয়াসিসের চিকিৎসা সাধারণত
অ্যান্টি-ফিলারিয়াল ড্রাগ ব্যবহার দ্বারা করা হয়। কিছু পরামর্শযোগ্য চিকিৎসা:
- অ্যান্টিফিলারিয়াল ঔষধ:
- ডিক্লোরোভার (Diethylcarbamazine,
DEC): এটি প্রধান চিকিৎসা যা
ফিলিয়ারিয়ার পরজীবী কিল করতে ব্যবহৃত হয়।
- আইভারমেকটিন (Ivermectin): মশার মাধ্যমে ছড়ানো পরজীবীর বিস্তার
নিয়ন্ত্রণে এটি কার্যকর।
- মেবেনডাজল (Mebendazole): এটি একটি অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক
ড্রাগ যা ফিলিয়ারিয়া আক্রান্তের চিকিৎসায় ব্যবহার হয়।
- পায়ে ফোলাভাব (এলিফ্যান্টিয়াসিস) কমানোর জন্য চিকিৎসা:
আক্রান্ত পায়ে ফোলাভাব বা কুঁজো হওয়ার সমস্যার জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা, যেমন ড্রেনিং বা সিকিউরিটি ওয়ার্কশপ, ফিজিওথেরাপি এবং দ্রুত লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের কার্যকারিতা পুনঃস্থাপন করা যেতে পারে। - পানি ও স্যালাইন সমাধান:
শরীরে জলীয় পদার্থের ঘাটতি দূর করতে পর্যাপ্ত পানি এবং স্যালাইন সমাধান দেওয়া উচিত। - পদার্থের মাধ্যমে ব্যথা ও প্রদাহ কমানো:
ব্যথা বা প্রদাহের জন্য পরামর্শ দেওয়া ব্যথানাশক (Painkillers) বা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ (Anti-inflammatory drugs) ব্যবহার করা যেতে পারে। - বিশ্রাম এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস:
শিশুকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং শক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য সুষম খাদ্য দেওয়া উচিত।
লিমফাটিক ফিল্যারিয়াসিস সম্পর্কে
পরামর্শ ও সতর্কতা:
- মশাবাহিত রোগের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি:
মশাবাহিত রোগের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মশার প্রজননস্থল নির্মূল করা জরুরি। - শিশুদের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ:
শিশুর মধ্যে ফিলিয়ারিয়াসিসের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আক্রান্ত শিশুর অবস্থা নির্ধারণের জন্য সঠিক পরীক্ষা করা উচিত। - প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:
মশা থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্য সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা (যেমন, মশারি, স্প্রে, ওষুধ) অবলম্বন করা প্রয়োজন। - যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা গ্রহণ:
রোগটি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং ফোলাভাব বা কুঁজো হওয়া শুরু হয়, তবে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিত। আক্রান্ত স্থানটি নিয়মিত পরিষ্কার রাখার মাধ্যমে সেকেন্ডারি সংক্রমণ রোধ করা যেতে পারে।
উপসংহার:
লিমফাটিক ফিল্যারিয়াসিস একটি
মশাবাহিত প্যারাসিটিক রোগ, যা শিশুর শরীরের
লিম্ফ সিস্টেমে সমস্যা সৃষ্টি করে। এটি সাধারণত মশার কামড় থেকে ছড়ায় এবং এটি
নিয়মিত চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। সঠিক সময়
চিকিৎসা শুরু করলে এই রোগ থেকে সুস্থ হওয়া সম্ভব, তবে দেরি
হলে এটি স্থায়ী শারীরিক ক্ষতি সৃষ্টি করতে পারে।
ঘোষণা: এই ওয়েবসাইটে (Bangla Articles) প্রকাশিত সকল লেখনি লেখক ও ওয়েব এডমিন মুহাম্মাদ আল-আমিন খান কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। Bangla Articles এর কোনো লেখনি থেকে সম্পূর্ণ অথবা আংশিক কপি করে সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্য কোনো ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা যাবে না। কোনো লেখনি ভালো লাগলে ও প্রয়োজনীয় মনে হলে এই ওয়েবসাইট থেকেই তা পড়তে পারেন অথবা ওয়েব লিংক শেয়ার করতে পারেন। গুগল সার্চ থেকে দেখা গেছে যে- বহু লেখনি কতিপয় দুষ্কৃতিকারী নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন, যা সম্পূর্ণরূপে কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন। ভবিষ্যতে আবারও এমনটি হলে প্রথমত গুগলের কাছে রিপোর্ট করা হবে ও দ্বিতীয়ত তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কপিরাইট আইনের আওতায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সাথে সকলের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে- Bangla Articles এ প্রকাশিত কোনো লেখনি আপনার ভালো না-ও লাগতে পারে, প্রয়োজনে আপনি এর সমালোচনা কমেন্টের মাধ্যমে করতে পারেন। বাক স্বাধীনতা, চিন্তার বহিঃপ্রকাশ করার অধিকার ও লেখালেখি করার অভ্যাসের জায়গা থেকে লেখক যা ইচ্ছা তাই লিখতে পারেন। তবে তিনি তার যেকোনো লেখনির ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন যাতে করে শালীনতা বজায় রাখা যায় এবং অন্যের ধর্মীয় অনুভূতি, মূল্যবোধ ও অধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা যায়। - মুহাম্মাদ আল-আমিন খান, লেখক ও ওয়েব এডমিন, Bangla Articles