বাংলাদেশে
আর কখনো ইন্টারনেট বন্ধ করা যাবে না: টেলিযোগাযোগ খাতে ঐতিহাসিক আইন সংস্কার
বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ও
ডিজিটাল অধিকার ইতিহাসে ২০২৫ সাল একটি স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে। দীর্ঘদিন ধরে
আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত ইন্টারনেট শাটডাউন ও নির্বিচার নজরদারির
আশঙ্কার অবসান ঘটিয়ে সরকার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধন)
অধ্যাদেশ, ২০২৫–এর খসড়া।
এই অধ্যাদেশের সবচেয়ে যুগান্তকারী ঘোষণা হলো—বাংলাদেশে আর কখনো ইন্টারনেট বা
কোনো ধরনের টেলিযোগাযোগ সেবা বন্ধ করা যাবে না।
এই সিদ্ধান্ত শুধু একটি
প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়; এটি নাগরিক অধিকার, মতপ্রকাশের
স্বাধীনতা, ডিজিটাল অর্থনীতি, বিনিয়োগ
পরিবেশ এবং রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে এক মৌলিক রূপান্তর। দীর্ঘদিন ধরে যে
প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছিল—“প্রয়োজনে কি ইন্টারনেট বন্ধ করা উচিত?”—এই অধ্যাদেশ সেই প্রশ্নের চূড়ান্ত আইনি উত্তর দিয়েছে।
ইন্টারনেট
বন্ধের সংস্কৃতির অবসান: ধারা ৯৭–এর তাৎপর্য
সংশোধিত অধ্যাদেশের সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন এসেছে ধারা ৯৭–এর মাধ্যমে। এই
ধারায় সরাসরি ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে—
ইন্টারনেট বা কোনো প্রকার
টেলিযোগাযোগ সেবা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বন্ধ করা যাবে না।
এর ফলে অতীতে ব্যবহৃত “জরুরি
অবস্থা”, “জননিরাপত্তা”, কিংবা “প্রশাসনিক
প্রয়োজন”–এর মতো অস্পষ্ট অজুহাত দেখিয়ে ইন্টারনেট বন্ধের যে চর্চা ছিল, তার আইনি ভিত্তি বিলুপ্ত হলো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধারা কার্যকর হলে—
- নাগরিকের তথ্য পাওয়ার অধিকার সুরক্ষিত হবে
- জরুরি স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং ও ডিজিটাল সেবা ব্যাহত হবে না
- গণমাধ্যম ও অনলাইন সাংবাদিকতা স্বাধীনভাবে
কাজ করতে পারবে
- ডিজিটাল অর্থনীতি ও ফ্রিল্যান্সিং খাত
স্থিতিশীল হবে
২০১০ সালের
বিতর্কিত কাঠামো থেকে সরে আসার প্রেক্ষাপট
২০১০ সালের টেলিযোগাযোগ আইন
সংশোধনের পর থেকেই বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রক কাঠামো নিয়ে অসন্তোষ ছিল। বিশেষ করে—
- মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত ক্ষমতা
- বিটিআরসির স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়া
- লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব
এই সংশোধিত অধ্যাদেশ সেই
পুরোনো কাঠামো থেকে সরে এসে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও আধুনিক নিয়ন্ত্রক মডেল প্রতিষ্ঠার
চেষ্টা করেছে।
লাইসেন্স
ব্যবস্থাপনায় মৌলিক পরিবর্তন
নতুন আইনে লাইসেন্স প্রদান
সংক্রান্ত ক্ষমতা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে।
কী পরিবর্তন
হলো?
- সব লাইসেন্স মন্ত্রণালয়ের হাতে কেন্দ্রীভূত
রাখার পদ্ধতি বাতিল
- জাতীয় কৌশলগত গুরুত্বসম্পন্ন লাইসেন্স
ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টাডির মাধ্যমে মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেবে
- সাধারণ ও কারিগরি লাইসেন্স প্রদানের ক্ষমতা
আবার বিটিআরসির কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে
এর ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে
পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে বলে আশা করা
হচ্ছে।
বিটিআরসির
স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা: নতুন ভারসাম্য
বিটিআরসিকে শুধু স্বাধীন করাই
নয়, তাকে আরও জবাবদিহিমূলক করতেও সংশোধিত আইনে একাধিক বিধান যুক্ত
হয়েছে।
নতুন
বাধ্যবাধকতাগুলো হলো—
- প্রতি চার মাসে একবার উন্মুক্ত গণশুনানি
- গণশুনানির সিদ্ধান্ত ও অগ্রগতি কমিশনের
ওয়েবসাইটে প্রকাশ
- স্বার্থের সংঘাত রোধে আলাদা ধারা (ধারা ৮৭)
- লাইসেন্স নিষ্পত্তির সময়সীমা নির্ধারণ
- অযৌক্তিক জরিমানা ও শাস্তিমূলক ধারা
যৌক্তিকীকরণ
এই ব্যবস্থাগুলো নিয়ন্ত্রক
সংস্থার ওপর জনআস্থা বাড়াবে।
নাগরিক
গোপনীয়তা ও ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় যুগান্তকারী অগ্রগতি
ডিজিটাল যুগে ব্যক্তিগত তথ্য
সুরক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। সংশোধিত অধ্যাদেশে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান নেওয়া
হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ
বিধানসমূহ
ধারা ৭১
অনুযায়ী—
- সিম ও ডিভাইস রেজিস্ট্রেশন তথ্য ব্যবহার করে
কোনো নাগরিককে বেআইনি নজরদারি বা হয়রানি করা দণ্ডনীয় অপরাধ
- ভয়েস ও ইমেজ ডেটা সুরক্ষার বাধ্যবাধকতা
- ডেটা সংরক্ষণ ও ব্যবহারে সীমা নির্ধারণ
এটি ডিজিটাল প্রাইভেসি
রক্ষায় একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছে।
‘স্পিচ অফেন্স’ ধারা
সংশোধন: মতপ্রকাশে নতুন স্বস্তি
আগের আইনে “স্পিচ অফেন্স”
সংক্রান্ত ধারাগুলো ছিল অত্যন্ত অস্পষ্ট ও বিস্তৃত, যার
অপব্যবহার নিয়ে দীর্ঘদিন উদ্বেগ ছিল। নতুন সংশোধনে এই ধারাগুলো সাইবার সুরক্ষা
অধ্যাদেশ ২০২৫–এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়েছে।
এখন কী
অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে?
- কেবলমাত্র সহিংসতার সরাসরি উসকানি বা আহ্বান
এর ফলে—
- সমালোচনা
- মতামত প্রকাশ
- নীতিগত বিরোধিতা
আর সহজে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত
হবে না।
এনটিএমসি
বিলুপ্ত: নজরদারিতে নতুন কাঠামো
নজরদারি ব্যবস্থায় সবচেয়ে
বড় পরিবর্তন এসেছে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন্স মনিটরিং সেন্টার (NTMC) বিলুপ্তির মাধ্যমে।
এর পরিবর্তে গঠিত হচ্ছে—
সেন্টার ফর
ইনফরমেশন সাপোর্ট (CIS)
CIS–এর বৈশিষ্ট্য
- নিজে কোনো ইন্টারসেপশন পরিচালনা করবে না
- কেবল কারিগরি সহায়তা প্রদান করবে
- ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা আইনের অধীন থাকবে
- রোল–বেজড অ্যাক্সেস কন্ট্রোল প্রয়োগ
আইনানুগ
ইন্টারসেপশন: সীমা ও নিয়ন্ত্রণ
নতুন আইনে নজরদারির
ক্ষেত্রগুলো নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
কোন
ক্ষেত্রে ইন্টারসেপশন সম্ভব?
- জাতীয় নিরাপত্তা
- গুরুতর অপরাধ তদন্ত
- জরুরি প্রাণরক্ষা
- আন্তঃসীমান্ত অপরাধ
তাও শুধুমাত্র আধা–বিচারিক
কাউন্সিলের অনুমোদনে।
আধা–বিচারিক
কাউন্সিল ও সংসদীয় তদারকি
আধা–বিচারিক
কাউন্সিলের ভূমিকা
- বেআইনি নজরদারির অভিযোগ গ্রহণ
- ইন্টারসেপশন অনুমোদন ও পর্যালোচনা
সদস্যরা
- আইন, বিচার ও সংসদ
বিষয়ক মন্ত্রী (সভাপতি)
- প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার
- স্বরাষ্ট্র সচিব
সংসদীয়
নজরদারি
- ডাক ও টেলিযোগাযোগ সম্পর্কিত সংসদীয়
স্থায়ী কমিটি
- বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ
- বাজেট ও সক্ষমতার তথ্য প্রকাশ
আন্তর্জাতিক
মান ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, এই সংশোধন—
- জাতিসংঘের ডিজিটাল অধিকার নীতিমালা
- আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (ITU)
- বৈশ্বিক উত্তম অনুশীলন
এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
উপসংহার: বাংলাদেশ
টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ কেবল একটি আইন পরিবর্তন নয়;
এটি ডিজিটাল বাংলাদেশে নাগরিক অধিকার, গোপনীয়তা, মতপ্রকাশ ও জবাবদিহিতার এক নতুন ভিত্তি স্থাপন করেছে। ইন্টারনেট শাটডাউন নিষিদ্ধকরণ, নজরদারিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, বিটিআরসির পুনঃস্বাধীনতা
এবং স্পিচ অফেন্সের সীমিত সংজ্ঞা—সব মিলিয়ে এটি টেলিযোগাযোগ খাতে একটি
যুগান্তকারী সংস্কার।
প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
১. এই আইনের ফলে কি সত্যিই ইন্টারনেট বন্ধ করা যাবে না?
হ্যাঁ, আইনগতভাবে ইন্টারনেট বন্ধের সব পথ
নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
২. জরুরি অবস্থায়ও কি ইন্টারনেট চালু থাকবে?
আইন অনুযায়ী হ্যাঁ, বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে;
বন্ধ করা যাবে না।
৩. বিটিআরসি কি এখন স্বাধীন?
আগের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীন ও জবাবদিহিমূলক।
৪. নাগরিকের কল বা ডেটা কি সহজে নজরদারিতে পড়বে?
না, কঠোর অনুমোদন ছাড়া সম্ভব নয়।
৫. CIS কি নজরদারি সংস্থা?
না, এটি কেবল কারিগরি সহায়ক প্রতিষ্ঠান।
৬. স্পিচ অফেন্স কি পুরোপুরি বাতিল?
না, সহিংসতার উসকানি এখনো অপরাধ।
৭. এই আইন কি বিনিয়োগে প্রভাব ফেলবে?
ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
৮. সংসদীয় তদারকি কীভাবে হবে?
বার্ষিক প্রতিবেদন ও কমিটির নজরদারির মাধ্যমে।
৯. আন্তর্জাতিক মহলে এর গ্রহণযোগ্যতা কেমন?
আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে বিবেচিত।
১০. সাধারণ নাগরিকের জীবনে এর প্রভাব কী?
নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট, অধিক স্বাধীনতা ও
নিরাপত্তা।
বাংলাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ আইন, ইন্টারনেট শাটডাউন নিষিদ্ধ বাংলাদেশ, টেলিযোগাযোগ সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৫, Bangladesh Telecommunication Amendment 2025, বাংলাদেশ ইন্টারনেট আইন নতুন আপডেট, ইন্টারনেট বন্ধ করা যাবে না আইন, BTRC নতুন আইন ২০২৫, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন পরিবর্তন, ইন্টারনেট শাটডাউন আইন বাংলাদেশ, নাগরিক গোপনীয়তা আইন বাংলাদেশ, স্পিচ অফেন্স ধারা সংশোধন, CIS Center Bangladesh, NTMC বাতিল আইন, আইনানুগ ইন্টারসেপশন বাংলাদেশ, ডিজিটাল অধিকার বাংলাদেশ, ইন্টারনেট স্বাধীনতা বাংলাদেশ, টেলিযোগাযোগ খাতে সংস্কার, Bangladesh internet freedom law, বাংলাদেশ ডিজিটাল আইন আপডেট, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ নিষেধাজ্ঞা
.png)
