বদনজর থেকে
বাঁচার দোয়া অর্থসহ বাংলা উচ্চারণ | কোরআন ও হাদিসের
আলোকে পূর্ণ হেফাজতের আমল
মানুষের জীবন সুখ–দুঃখ, সুস্থতা–অসুস্থতা, উন্নতি–অবনতির মধ্য দিয়ে আবর্তিত।
এই জীবনে অনেক সময় এমন কিছু অদৃশ্য ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, যার
কারণ আমরা সহজে বুঝতে পারি না। ইসলামের দৃষ্টিতে এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো বদনজর
(নযর বা কুদৃষ্টি)। বদনজর একটি
বাস্তব সত্য, যা কোরআন ও সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
ইসলাম আমাদের শুধু সমস্যা
সম্পর্কে সতর্ক করেনি, বরং প্রতিটি বিপদ থেকে রক্ষার জন্য কার্যকর
দোয়া ও আমলও শিক্ষা দিয়েছে। বদনজর থেকে হেফাজতের দোয়াগুলো তারই উজ্জ্বল
দৃষ্টান্ত।
বদনজর কী? ইসলামের দৃষ্টিতে বদনজরের বাস্তবতা
বদনজর বলতে বোঝায়—কারো
প্রশংসা, হিংসা বা বিস্ময়ের দৃষ্টির মাধ্যমে অন্য কারো ওপর অদৃশ্য
ক্ষতিকর প্রভাব পড়া। এই দৃষ্টি ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত—উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষতির
কারণ হতে পারে।
ইসলামে বদনজরকে কুসংস্কার
হিসেবে অস্বীকার করা হয়নি; বরং একে বাস্তব ও কার্যকর কারণ হিসেবে
স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
কোরআনে
বদনজরের উল্লেখ
পবিত্র কোরআনে সূরা কলমে
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—
“কাফেররা যখন
উপদেশবাণী শোনে, তখন তারা যেন তাদের দৃষ্টির মাধ্যমে তোমাকে
আছড়ে ফেলবে; আর তারা বলে—এ তো এক উন্মাদ।” (সূরা কলম: ৫১)
তাফসিরে
ইবনে কাসিরের ব্যাখ্যা
বিশিষ্ট মুফাসসির আল্লামা
ইবনে কাসির (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন—হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে
বর্ণিত, এখানে “দৃষ্টির মাধ্যমে আছড়ে ফেলা” বলতে মূলত বদনজর
দেওয়াকেই বোঝানো হয়েছে।
অর্থাৎ, তারা তাদের হিংসাত্মক দৃষ্টির
মাধ্যমে নবীজি (স.)-কে অসুস্থ বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইত। তবে আল্লাহর হেফাজত থাকায়
তারা এতে সফল হয়নি। এই ব্যাখ্যা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে বদনজর মানুষের শরীর ও
মনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড ৪)
বদনজরের
প্রভাব কার ওপর বেশি পড়ে?
ইসলামি বিদ্বানদের মতে, সাধারণত বদনজরের প্রভাব পড়ে—
- সুন্দর ও সুস্থ ব্যক্তির ওপর
- ছোট শিশুদের ওপর
- হঠাৎ উন্নতি বা সাফল্য অর্জনকারীর ওপর
- সম্পদশালী বা মর্যাদাবান ব্যক্তির ওপর
- যাদের প্রশংসা করা হয় আল্লাহর নাম না নিয়ে
বিশেষ করে শিশুরা বদনজরের
ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ—কারণ তারা দুর্বল ও সংবেদনশীল।
বদনজর থেকে বাঁচার সুন্নতি দোয়া (জিবরাইল আ. কর্তৃক পঠিত)
হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রসুলুল্লাহ (স.) অসুস্থ হলে জিবরাইল (আ.) তাঁর কাছে এসে একটি দোয়া
পাঠ করেন।
দোয়াটি (আরবি)
بِاسْمِ اللهِ أَرْقِيكَ، مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ،
مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ،
اللهُ يَشْفِيكَ، بِاسْمِ اللهِ أَرْقِيكَ
বাংলা উচ্চারণ
বিসমিল্লাহি আরকিকা, মিন কুল্লি শাইয়িন
ইউজিকা,
মিন শাররি কুল্লি নাফসিন আউ আইনিন হাসিদিন,
আল্লাহু ইয়াশফিকা, বিসমিল্লাহি আরকিকা।
অর্থ
আমি আল্লাহর নামে তোমার ওপর ঝাড়-ফুঁক করছি।
সবকিছু থেকে যা তোমাকে কষ্ট দেয়,
সব আত্মার অনিষ্ট ও হিংসুকের বদনজর থেকে—
আল্লাহ তোমাকে আরোগ্য দান করুন।
আল্লাহর নামেই আমি তোমার জন্য দোয়া করছি।
(সহিহ মুসলিম)
এই দোয়াটি আক্রান্ত ব্যক্তির
ওপর বারবার পড়ে ফুঁ দিলে আল্লাহর ইচ্ছায় বদনজরের প্রভাব দূর হয়।
সকাল–সন্ধ্যার
শক্তিশালী হেফাজতের দোয়া
রসুলুল্লাহ (স.) এমন একটি
দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন, যা সকাল ও সন্ধ্যায় পাঠ করলে হঠাৎ বিপদ,
রোগ ও বদনজর থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়।
দোয়াটি (আরবি)
بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ
فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ
وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
বাংলা উচ্চারণ
বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মা‘আসমিহি শাইউন
ফিল আরদি ওয়া লা ফিস সামা
ওয়া হুয়াস সামিউল আলিম।
অর্থ: আমি
সেই আল্লাহর নামে শুরু করছি, যাঁর নামের বরকতে আকাশ ও পৃথিবীর
কোনো কিছুই ক্ষতি করতে পারে না। তিনি সবকিছু শোনেন, সবকিছু
জানেন।
ফজিলত: যে
ব্যক্তি সকালবেলা তিনবার এ দোয়া পড়বে—সন্ধ্যা পর্যন্ত সে নিরাপদ থাকবে। আর
সন্ধ্যায় তিনবার পড়লে—সকাল পর্যন্ত সে হেফাজতে থাকবে। (আবু দাউদ, তিরমিজি)
শিশুদের বদনজর থেকে রক্ষার দোয়া
রসুলুল্লাহ (স.) তাঁর নাতি হজরত হাসান ও হুসাইন (রা.)-কে
কোলে নিয়ে নিয়মিত একটি বিশেষ দোয়া পড়তেন।
দোয়াটি (আরবি)
أُعِيذُكُمَا بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ
مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ
وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لَامَّةٍ
উচ্চারণ
উয়ীযুকুমা বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি
মিন কুল্লি শাইতানিন ওয়া হাম্মাতিন
ওয়া মিন কুল্লি আইনিন লাম্মাতিন।
অর্থ: আমি
তোমাদের আল্লাহর পরিপূর্ণ কালিমাসমূহের মাধ্যমে আশ্রয় দিচ্ছি—সব শয়তান, ক্ষতিকর জীব ও বদনজর থেকে।
এই দোয়া নবীজি (স.)-এর
পূর্বসূরি হজরত ইবরাহিম (আ.)-ও তাঁর সন্তানদের জন্য পড়তেন।
(সহিহ বুখারি)
বদনজর
কাটানোর সহজ আমলসমূহ
- দোয়া পড়ে হাতে বা পানিতে ফুঁ দেওয়া
- তিনবার পড়ে শিশুর শরীরে ফুঁ দেওয়া
- সকাল–সন্ধ্যার যিকির নিয়মিত করা
- সন্তান বা নিজের প্রশংসা শুনলে “মাশাআল্লাহ”
বলা
- অযু অবস্থায় থাকা
বদনজর থেকে
বাঁচার বিষয়ে ১০টি প্রশ্ন ও উত্তর
১. বদনজর কি
সত্যিই মানুষের ক্ষতি করে?
হ্যাঁ, কোরআন ও হাদিস অনুযায়ী বদনজর বাস্তব এবং ক্ষতিকর হতে পারে।
২. বদনজর
লাগলে কী লক্ষণ দেখা যায়?
হঠাৎ অসুস্থতা, অস্বাভাবিক কান্না, মন খারাপ, অলসতা,
ভয় পাওয়া ইত্যাদি।
৩. শিশুদের
বদনজর বেশি লাগে কেন?
তারা দুর্বল ও বেশি প্রশংসার
পাত্র হওয়ায়।
৪. বদনজর
কাটাতে কতদিন দোয়া পড়তে হয়?
নির্দিষ্ট সময় নেই; সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত নিয়মিত পড়া উত্তম।
৫. পানিতে
ফুঁ দিয়ে খাওয়ানো কি জায়েজ?
হ্যাঁ, সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
৬. বদনজর কি
শুধু হিংসা থেকে হয়?
না, প্রশংসা বা বিস্ময় থেকেও হতে পারে।
৭. দোয়া না
পড়লে কি বদনজর লাগবেই?
আল্লাহ চাইলে রক্ষা করতে
পারেন, তবে দোয়া সুন্নত ও নিরাপদ মাধ্যম।
৮. বদনজরের
জন্য তাবিজ জরুরি কি?
না, সহিহ দোয়াই যথেষ্ট।
৯. নিজের
ওপর নিজেই বদনজর লাগে?
সাধারণত না, তবে অহংকার ক্ষতিকর হতে পারে।
১০.
প্রতিদিন কোন দোয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?
“বিসমিল্লাহিল্লাজি…”
দোয়াটি সকাল–সন্ধ্যায় পড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার: বদনজর
কোনো কুসংস্কার নয়; বরং ইসলামে স্বীকৃত একটি বাস্তব বিষয়। তবে
ভয়ের কিছু নেই—কারণ আল্লাহ আমাদের জন্য দোয়া ও আমলের মাধ্যমে পূর্ণ সুরক্ষার
ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। নিয়মিত দোয়া, যিকির ও আল্লাহর ওপর
ভরসাই হলো বদনজর থেকে বাঁচার সবচেয়ে শক্তিশালী ঢাল।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে
বদনজর ও সব ধরনের অদৃশ্য অনিষ্ট থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
বদনজর থেকে বাঁচার দোয়া, বদনজর কাটানোর দোয়া বাংলা অর্থসহ, বদনজর থেকে হেফাজতের দোয়া, কুদৃষ্টি থেকে বাঁচার ইসলামিক দোয়া, বদনজর কি এবং এর চিকিৎসা, বদনজর সম্পর্কে কোরআন ও হাদিস, শিশুদের বদনজর থেকে রক্ষার দোয়া, সকাল সন্ধ্যার হেফাজতের দোয়া, বিসমিল্লাহিল্লাজি দোয়ার ফজিলত, জিবরাইল আ এর পড়া দোয়া, বদনজর লাগলে কি করতে হবে, বদনজরের লক্ষণ ও সমাধান, ইসলামিক ঝাড়ফুঁক দোয়া, বদনজর কাটানোর আমল, দোয়া দিয়ে বদনজর দূর করার উপায়, কোরআনের আলোকে বদনজর, হাদিসে বদনজরের প্রমাণ, শিশুর ওপর বদনজর লাগলে করণীয়, বদনজর থেকে সুরক্ষার যিকির, বদনজর থেকে রক্ষা পাওয়ার দোয়া বাংলা
.png)
