জনগণের করের টাকা কোথায় যায়? রাজনৈতিক
শোষণ বুঝতে সাধারণ নাগরিকের গাইড
রাষ্ট্র পরিচালনার মূল জ্বালানি হল জনগণের কর।
মানুষ আয় করে, ব্যবসা করে, পণ্য কিনে—তার প্রতিটি ধাপে সরকার কর
আদায় করে। কিন্তু বছরের শেষে হিসাব কষলে সাধারণ মানুষের মনে একটি প্রশ্নই ঘুরপাক
খায় "আমাদের দেওয়া করের টাকা আসলে কোথায় যায়?"
এই প্রশ্ন শুধু কৌতূহলের নয়; এটি গণতন্ত্র,
জবাবদিহি ও রাজনৈতিক শোষণ বোঝার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
এ ব্লগটির উদ্দেশ্য হলো সহজ ভাষায়, বাস্তব
উদাহরণ সহ ব্যাখ্যা করা—কীভাবে কর সংগ্রহ হয়, সরকার কীভাবে
ব্যয় করে, এবং কোথায় কোথায় রাজনৈতিক শোষণ লুকিয়ে থাকে।
১. কর সংগ্রহ – রাষ্ট্রের
আয়ের প্রধান উৎস
বাংলাদেশে সরকারের আয় মূলত দুই ধরনের কর থেকে
আসে—
ক. প্রত্যক্ষ কর (Direct Tax)
- আয়কর
- কর্পোরেট ট্যাক্স
- সম্পদ কর
খ. পরোক্ষ কর (Indirect Tax)
- ভ্যাট (VAT)
- কাস্টমস ডিউটি
- এক্সাইজ শুল্ক
সাধারণ মানুষ প্রতিদিন বাজারে গিয়ে, মোবাইল
রিচার্জ করে, বাস–ট্রেনে ভ্রমণ করে—অজান্তেই সরকারের রাজস্ব
বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ, জনগণই রাষ্ট্রের মূল অর্থদাতা।
২. করের টাকা সরকার কোথায়
ব্যয় করে?
১) প্রশাসন পরিচালনা
মন্ত্রণালয়, সরকারি অফিস, বেতন–ভাতা,
গাড়ি, রক্ষণাবেক্ষণ—সবই আপনার করের টাকায় চলে।
২) অবকাঠামো নির্মাণ
- রাস্তা
- সেতু
- হাসপাতাল
- স্কুল
- বিদ্যুৎ ও পানি সুবিধা
এগুলোর পেছনে সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যয় বরাদ্দ
থাকে।
৩) শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত
সরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়,
হাসপাতাল, টিকাদান কর্মসূচি ইত্যাদি।
৪) সামাজিক নিরাপত্তা
কর্মসূচি
- বয়স্ক ভাতা
- বিধবা ভাতা
- প্রতিবন্ধী ভাতা
- খাদ্য সহায়তা
৫) প্রতিরক্ষা: সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী,
বিমানবাহিনী, সীমান্ত নিরাপত্তা।
৬) ঋণের সুদ পরিশোধ: প্রতিবছর রাষ্ট্রকে
দেশি–বিদেশি ঋণের বিপুল সুদ পরিশোধ করতে হয়—এটিও জনগণের করের টাকায়। এগুলো
হলো কর ব্যয়ের ‘আদর্শ’ খাত। কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময় এর বাইরেও চলে যায়—যেখানে
শোষণ, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িয়ে থাকে।
৩. রাজনৈতিক শোষণ কোথায়
হয়—অদৃশ্য কিন্তু খুবই বাস্তব ৫টি ক্ষেত্র
কর আদায় যতটা স্বচ্ছভাবে হয়, ব্যয় ততটা
স্বচ্ছ হয় না। এখানেই শোষণের জন্ম।
১) প্রকল্প ব্যয়ের ফুলে–ফেঁপে
ওঠা (Project
Cost Inflation): একটি ব্রিজের প্রকৃত খরচ হতে পারে ২০০ কোটি, কিন্তু
অনুমোদিত প্রকল্প দেখায় ৫০০ কোটি।
কেন?
- কমিশন
- ঘুষ
- রাজনৈতিক ফান্ডিং
- টেন্ডার কারসাজি
ফলাফল— আপনার ২০০ টাকার কাজের জন্য হয়ত ৫০০ টাকা
নেওয়া হলো!
২) অকার্যকর বা ‘ঘুমন্ত’
প্রকল্প (White Elephant Projects): এ ধরনের প্রকল্প শুধু কাগজে–কলমে থাকে, বাস্তবে কোনো
ব্যবহার নেই। উদাহরণ: খরস্রোতা নদীতে নৌবন্দর বানানো, যেখানে
বছরজুড়ে নৌচলাচল হয় না। .এগুলোর উদ্দেশ্য সাধারণত দুইটি—
- রাজনৈতিক এলাকার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি
- সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পকেট ভারী করা
৩) বরাদ্দের রাজনৈতিক পক্ষপাত
(Political
Allocation Bias): সংসদ সদস্য, মন্ত্রী বা রাজনৈতিক দলের শক্ত ঘাঁটিতে
বেশি উন্নয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়। যেসব এলাকায় দলের ভোটব্যাংক কম, সেখানে বরাদ্দও কম। এটি করদাতার সঙ্গে সবচেয়ে বড় অবিচার—কারণ মানুষের কর সমান হলেও সেবা সমান নয়।
৪) দুর্নীতির জাল – ছোট থেকে
বড় সব স্তরেই
- সরকারি মালামাল অতিরিক্ত দামে ক্রয়
- ভুয়া বিল–ভাউচার
- ফাইল ঘোরাতে ঘুষ
- প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ
টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিটি বড়
উন্নয়ন প্রকল্পে ১৫%–৩০% পর্যন্ত অর্থ অপচয় হয়।
এ অর্থ কার?—আপনার, আমার,
সাধারণ নাগরিকের।
৫) ঋণের ফাঁদ: করের টাকা দিয়ে
সুদ শোধ:
দেশ
যখন ঋণ নেয়, সেই টাকায় অনেক সময় রাজনৈতিক শো–পিস প্রকল্প করা হয়। কিন্তু সুদ পরিশোধ
করতে হয় জনগণকে— আবারও কর বাড়িয়ে, আবারও পরোক্ষ কর দিয়ে। এটাই
রাজনৈতিক শোষণের সবচেয়ে সূক্ষ্ম রূপ।
৪. সাধারণ নাগরিকের দৃষ্টিতে
কর–ব্যয় বোঝা কেন জরুরি?
(১) জবাবদিহি দাবি করার অধিকার তৈরি হয়
আপনি জানেন আপনার টাকা কোথায় খরচ হচ্ছে—তখন
প্রশ্নও তুলতে পারেন।
(২) ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত আরও সচেতন হয়
যে রাজনৈতিক দল বা নেতৃত্ব করের টাকায় উন্নয়ন
করেছে—তাদেরই মূল্যায়ন করা সহজ।
(৩) দুর্নীতি কমে আসে
স্বচ্ছতা বাড়লে দুর্নীতি টিকে থাকতে পারে না।
জনগণের সচেতনতা রাজনৈতিক শোষণের বড় শত্রু।
(৪) নিজের এলাকার উন্নয়ন নজরে থাকে
মানুষ বুঝতে পারে—কর দিলে তার বিনিময়ে কী সুবিধা
পাচ্ছে।
৫. করের টাকা কীভাবে সঠিকভাবে
ব্যবহৃত হতে পারে – ৫টি ভালো পদ্ধতি
১. ওপেন বাজেট সিস্টেম
প্রতিটি প্রকল্পের খরচ ও ব্যয় গণমাধ্যমে প্রকাশ।
২. ই-গভর্নেন্স
অনলাইন ফাইল ট্র্যাকিং, ডিজিটাল
পেমেন্ট, ই–টেন্ডার দুর্নীতি কমাতে অত্যন্ত কার্যকর।
৩. নাগরিক অডিট
নাগরিকেরা সম্মিলিতভাবে উন্নয়ন প্রকল্প
পর্যবেক্ষণ করলে রাজনৈতিক শোষণ কমে।
৪. নিরপেক্ষ টেন্ডার ব্যবস্থা
একচেটিয়া ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।
৫. প্রতিটি টাকার বিনিময়ে
ফলাফল (Outcome-Based
Budget)
শুধু টাকা দেওয়া নয়—সেই টাকার ফলাফল কী, তা পরিমাপ
করা।
৬. উপসংহার: কর শুধু টাকা
নয়—এটি জনগণের ভবিষ্যৎ
আপনার দেওয়া করের প্রতিটি টাকা দেশের উন্নয়ন, ভবিষ্যৎ
প্রজন্মের শিক্ষা, আপনার সন্তানের স্বাস্থ্য এবং নিজের
জীবনমানের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। কিন্তু যখন করের টাকা রাজনৈতিক স্বার্থ,
দুর্নীতি বা অকার্যকর প্রকল্পে নষ্ট হয়—তখন শোষণ শুরু হয়। তাই
প্রতিটি সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব—
- কর কোথায় যাচ্ছে তা বোঝা
- রাজনৈতিক জবাবদিহি দাবি করা
- সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচন করা
কারণ একটি রাষ্ট্রের শক্তি তার নাগরিকের টাকায়, কিন্তু টাকার
সঠিক ব্যবহার তার নেতৃত্বের হাতে।
জনগণের করের টাকা কোথায় যায়, করের টাকা
ব্যয় হয় কোথায়, সরকার কর কীভাবে ব্যয় করে, রাজনৈতিক শোষণ কী, রাজনৈতিক দুর্নীতি বিশ্লেষণ,
কর ব্যবস্থার দুর্বলতা, সরকারি বাজেট বোঝার
সহজ উপায়, রাষ্ট্রের কর ব্যবহারের নিয়ম, কর ও রাজনৈতিক শোষণ, করের অপচয় উদাহরণ, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প দুর্নীতি, বাংলাদেশে কর আদায়
ও ব্যয়, করের টাকার হিসাব, কেন কর দিতে
হয়, সাধারণ নাগরিকের কর সচেতনতা, সরকারি
অর্থ কোথায় যায়, রাষ্ট্রীয় বাজেট বিশ্লেষণ, কর ও রাজনৈতিক অর্থনীতি, সরকারি ব্যয়ের স্বচ্ছতা,
জনগণের করের সঠিক ব্যবহার
ঘোষণা: এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সকল লেখনি সম্পাদক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। Bangla Articles এর কোনো লেখনি থেকে সম্পূর্ণ অথবা আংশিক কপি করে সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্য কোনো ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা যাবে না। কোনো লেখনি ভালো লাগলে ও প্রয়োজনীয় মনে হলে এই ওয়েবসাইট থেকেই তা পড়তে পারেন অথবা ওয়েব লিংক শেয়ার করতে পারেন। গুগল সার্চ থেকে দেখা গেছে যে- বহু লেখনি কতিপয় ব্যক্তি নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন, যা সম্পূর্ণরূপে কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন। ভবিষ্যতে আবারও এমনটি হলে প্রথমত গুগলের কাছে রিপোর্ট করা হবে ও দ্বিতীয়ত তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কপিরাইট আইনের আওতায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সাথে সকলের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে- Bangla Articles এ প্রকাশিত কোনো লেখনি আপনার ভালো না-ও লাগতে পারে, প্রয়োজনে আপনি এর সমালোচনা কমেন্টের মাধ্যমে করতে পারেন। বাক স্বাধীনতা, চিন্তার বহিঃপ্রকাশ করার অধিকার ও লেখালেখি করার অভ্যাসের জায়গা থেকে লেখক ও সম্পাদক যা ইচ্ছা তাই লিখতে পারেন। তবে তিনি তার যেকোনো লেখনির ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন যাতে করে শালীনতা বজায় রাখা যায় এবং অন্যের ধর্মীয় অনুভূতি, মূল্যবোধ ও অধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা যায়। - সম্পাদক, Bangla Articles
.png)
