যুবসমাজকে
কেন রাজনৈতিক শোষণের সহজ লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়?
যুবসমাজ কোনো দেশের সবচেয়ে
শক্তিশালী, উদ্যমী ও পরিবর্তনশীল অংশ। ইতিহাসের প্রতিটি বড় সামাজিক ও
রাজনৈতিক পরিবর্তনের পেছনে তরুণদের সক্রিয় ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশসহ
বিশ্বের বহু দেশে যুবসমাজ গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বাধীনতা
সংগ্রাম, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও সামাজিক সংস্কারে অগ্রণী
ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো—এই শক্তিশালী যুবসমাজই অনেক সময়
রাজনৈতিক শোষণের সবচেয়ে সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। কেন এমনটা ঘটে, কোন কোন কারণে যুবসমাজ রাজনৈতিক শোষণের শিকার হয়, এবং
এর পরিণতি কী—এসব বিষয় নিয়েই এই লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
১.
আবেগপ্রবণতা ও আদর্শবাদী মানসিকতা
যুবসমাজ সাধারণত আবেগপ্রবণ ও
আদর্শবাদী হয়ে থাকে। তারা ন্যায়বিচার, সাম্য, স্বাধীনতা, পরিবর্তন—এসব বড় বড় ধারণার প্রতি সহজেই
আকৃষ্ট হয়। এই বয়সে মানুষ বাস্তবতার কঠোর দিকগুলো পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারে না।
ফলে রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী যখন “দেশ বাঁচাও”, “গণতন্ত্র
রক্ষা করো”, “অন্যায় দূর করো”—এমন আবেগঘন স্লোগান দেয়,
তখন তরুণরা সহজেই প্রভাবিত হয়।
রাজনৈতিক শক্তিগুলো এই আবেগকে
কৌশলে ব্যবহার করে। তারা তরুণদের সামনে একটি আদর্শিক ছবি আঁকে, কিন্তু বাস্তবে সেই আদর্শ বাস্তবায়নের দায় বা ফলাফল যুবসমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে
দেয়। এতে তরুণরা আন্দোলনে নামলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তাদের হাতে থাকে না।
২.
অভিজ্ঞতার ঘাটতি ও বাস্তব জ্ঞান কম থাকা
যুবসমাজ জীবনের প্রাথমিক
পর্যায়ে থাকে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে
তাদের অভিজ্ঞতা তুলনামূলকভাবে কম। কোন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী
হতে পারে, ক্ষমতার রাজনীতির ভেতরের সমীকরণ কী—এসব বিষয় তারা
অনেক সময় বুঝে উঠতে পারে না।
এই অভিজ্ঞতার ঘাটতিকে
রাজনৈতিক নেতারা সুযোগ হিসেবে নেয়। তারা নির্বাচনী সময়, আন্দোলনের সময় কিংবা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তরুণদের সামনে আংশিক সত্য বা বিকৃত
তথ্য তুলে ধরে। যুবসমাজ যাচাই না করেই অনেক সময় তা বিশ্বাস করে মাঠে নেমে পড়ে।
৩.
কর্মসংস্থানের অভাব ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা
বেকারত্ব বা অপ্রতুল
কর্মসংস্থান যুবসমাজকে রাজনৈতিক শোষণের দিকে ঠেলে দেওয়ার অন্যতম বড় কারণ। যখন একজন
তরুণ শিক্ষিত হয়েও চাকরি পায় না, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে,
তখন সে হতাশ হয়ে পড়ে। এই হতাশা থেকে সে কোনো না কোনো আশ্রয় খোঁজে।
রাজনৈতিক সংগঠনগুলো এই
অবস্থাকে কাজে লাগায়। তারা তরুণদের বিভিন্ন লোভ দেখায়—চাকরির আশ্বাস, ঠিকাদারি সুবিধা, রাজনৈতিক পদ, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার সুযোগ ইত্যাদি। অনেক সময় এসব প্রতিশ্রুতি
বাস্তবায়িত হয় না, কিন্তু তরুণরা রাজনৈতিক সংঘর্ষ, সহিংসতা বা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে।
৪. পরিচয় ও
স্বীকৃতির আকাঙ্ক্ষা
যুব বয়সে মানুষের মধ্যে নিজের
পরিচয় তৈরি করার এবং সমাজে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা থাকে। পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র যখন সেই স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়, তখন
রাজনৈতিক পরিচয় তরুণদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
রাজনৈতিক দলগুলো তরুণদের
“কর্মী”, “নেতা”, “সংগ্রামী যোদ্ধা” হিসেবে পরিচয়
দেয়। এই পরিচয় তরুণদের আত্মসম্মান বাড়ায়, যদিও বাস্তবে তারা
অনেক সময় শুধু ব্যবহারযোগ্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সিদ্ধান্ত নেয় সিনিয়র
নেতারা, আর ঝুঁকি নেয় তরুণরা।
৫. সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব
বর্তমান যুগে সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যম যুবসমাজের চিন্তাধারা গঠনে বড় ভূমিকা রাখছে। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, এক্স—এসব
প্ল্যাটফর্মে রাজনৈতিক প্রচারণা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় ভুয়া খবর, অর্ধসত্য বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য তরুণদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
রাজনৈতিক শক্তিগুলো
পরিকল্পিতভাবে অনলাইন প্রচারণা চালায়, ট্রেন্ড তৈরি করে,
আবেগঘন ভিডিও বা পোস্ট ছড়িয়ে দেয়। যাচাই-বাছাইয়ের অভ্যাস না থাকায়
যুবসমাজ সহজেই এসব প্রচারণার ফাঁদে পড়ে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়।
৬. শিক্ষা
ব্যবস্থায় নাগরিক ও রাজনৈতিক শিক্ষার দুর্বলতা
অনেক দেশে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে, শিক্ষা
ব্যবস্থায় কার্যকর নাগরিক শিক্ষা বা রাজনৈতিক সচেতনতা যথেষ্ট গুরুত্ব পায় না।
শিক্ষার্থীরা ইতিহাস পড়ে, কিন্তু রাজনীতির বাস্তব কাঠামো,
গণতন্ত্রের চর্চা, নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ব
সম্পর্কে গভীরভাবে শেখে না।
ফলে যুবসমাজ রাজনীতিতে অংশ
নেয় আবেগ দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে নয়। এই দুর্বলতাই রাজনৈতিক
শোষণের পথ সহজ করে দেয়।
৭. সংগঠিত
শক্তি হিসেবে যুবসমাজের ক্ষমতা
যুবসমাজ সংখ্যায় বেশি এবং
শারীরিকভাবে সক্রিয়। মিছিল, সমাবেশ, আন্দোলন,
সংঘর্ষ—এসব ক্ষেত্রে তরুণদের ভূমিকা সবচেয়ে কার্যকর। রাজনৈতিক
দলগুলো জানে, ক্ষমতার লড়াইয়ে যুবসমাজকে ব্যবহার করা গেলে বড়
সুবিধা পাওয়া যায়।
কিন্তু এই সংগঠিত শক্তির
নিয়ন্ত্রণ থাকে রাজনৈতিক অভিজাতদের হাতে। ফলে যুবসমাজ আন্দোলনের সামনের সারিতে
থাকলেও লাভবান হয় না, বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৮. রাজনৈতিক
শোষণের পরিণতি
যুবসমাজ রাজনৈতিক শোষণের
শিকার হলে এর প্রভাব শুধু তরুণদের ওপর নয়, পুরো সমাজের ওপর
পড়ে।
- সহিংস রাজনীতি বাড়ে
- তরুণদের শিক্ষা ও ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়
- অপরাধপ্রবণতা ও চরমপন্থা বাড়ে
- গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি দুর্বল হয়
- ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব বিকৃত পথে গড়ে ওঠে
একটি জাতির সবচেয়ে সম্ভাবনাময়
অংশ যদি ভুল পথে পরিচালিত হয়, তবে সেই জাতির অগ্রগতি
বাধাগ্রস্ত হয়।
৯. উত্তরণের
পথ কী?
যুবসমাজকে রাজনৈতিক শোষণ থেকে
মুক্ত করতে হলে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে—
- কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত
করা
- শিক্ষা ব্যবস্থায় নাগরিক শিক্ষা জোরদার করা
- সমালোচনামূলক চিন্তা ও তথ্য যাচাইয়ের দক্ষতা
শেখানো
- রাজনৈতিক দলে তরুণদের প্রকৃত সিদ্ধান্ত
গ্রহণের সুযোগ দেওয়া
- সহিংস রাজনীতির পরিবর্তে নীতিনির্ভর
রাজনীতির চর্চা করা
উপসংহার: যুবসমাজ
শক্তি, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যতের প্রতীক। কিন্তু আবেগ, অভিজ্ঞতার অভাব, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সামাজিক
স্বীকৃতির তাড়নায় তারা অনেক সময় রাজনৈতিক শোষণের সহজ লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এই শোষণ শুধু
তরুণদের নয়, পুরো রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর।
যদি যুবসমাজকে সচেতন, শিক্ষিত ও আত্মনির্ভরশীল করে তোলা যায়, তাহলে তারা
আর রাজনৈতিক হাতিয়ার থাকবে না—বরং তারা হবে ন্যায়ভিত্তিক, দায়িত্বশীল
ও ইতিবাচক রাজনৈতিক পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি।
যুবসমাজ ও রাজনীতি, রাজনৈতিক শোষণ কী, যুবসমাজ কেন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়, তরুণ সমাজের রাজনৈতিক ভূমিকা, যুবরাজনীতি বাংলাদেশ, রাজনৈতিক দল ও যুবসমাজ, তরুণদের রাজনৈতিক সচেতনতা, যুবসমাজের রাজনৈতিক সমস্যা, ছাত্র রাজনীতি ও শোষণ, রাজনৈতিক আন্দোলনে যুবকদের ব্যবহার, যুবসমাজের আবেগ ও রাজনীতি, রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা যুবসমাজ, যুবসমাজ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, রাজনৈতিক সহিংসতায় যুবসমাজ, যুবকদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, গণতন্ত্র ও যুবসমাজ, রাজনৈতিক শিক্ষা ও তরুণ প্রজন্ম, বাংলাদেশে যুবরাজনীতির বাস্তবতা, তরুণদের রাজনৈতিক অধিকার ও দায়িত্ব, রাজনৈতিক সংস্কার ও যুবসমাজ
.png)
