শিশুদের টিটানাস প্রতিরোধ, চিকিৎসা, পরামর্শ ও সতর্কতা

Muhammad Al-Amin Khan, Editor in Chief of BA, BJN, BST
0


শিশুদের টিটানাস রোগ পরিচিতি, লক্ষণ, কারণ, প্রতিরোধ, প্রতিকার, চিকিৎসা, পরামর্শ ও সতর্কতা

শিশুদের টিটানাস (Tetanus) রোগ: পরিচিতি

টিটানাস একটি গুরুতর ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ যা সাধারণত আঘাতের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। এটি Clostridium tetani নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে ঘটে, যা মাটি, মল-মূত্র বা অন্যান্য পরিবেশে পাওয়া যায়। টিটানাস সাধারণত খোলামেলা ক্ষত বা আঘাতের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এবং স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে, যার ফলে পেশী শক্ত হয়ে যাওয়া, তীব্র ব্যথা এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা হতে পারে। এটি প্রাণঘাতীও হতে পারে, তবে টিকা গ্রহণের মাধ্যমে এটি প্রতিরোধযোগ্য।

টিটানাস রোগের লক্ষণ:

টিটানাসের লক্ষণ সাধারণত সংক্রমণের ৭ থেকে ২১ দিনের মধ্যে দেখা দিতে পারে, তবে এটি কখনও কখনও দ্রুত প্রকাশ পায়। লক্ষণগুলো হল:

  1. পেশীতে শক্তি বা স্টিফনেস:
    সবচেয়ে প্রাথমিক লক্ষণ হল গলার পেশী বা শরীরের অন্যান্য অংশে শক্ত হয়ে যাওয়া, যা পেশী সংকোচন বা অস্বাভাবিক দুলুনি সৃষ্টি করতে পারে।
  2. জিহ্বার বা গালের পেশী সংকোচন:
    মুখের পেশী শক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে শিশুর মুখ খুলতে সমস্যা হতে পারে এবং দাঁত চেপে রাখা কঠিন হতে পারে। এটি "ট্রাইসিমাস" (trismus) বা দাঁত পেষণ হিসেবেও পরিচিত।
  3. জ্বর এবং ঘাম:
    শিশুর জ্বর, তীব্র ঘাম, ঠাণ্ডা লাগা এবং শরীরের ব্যথা হতে পারে।
  4. শ্বাসকষ্ট এবং শ্বাসনালীতে সমস্যা:
    পেশী শক্ত হয়ে গেলে, শ্বাসযন্ত্রের পেশীও প্রভাবিত হতে পারে, যার ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দেয়। এটি শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি সৃষ্টি করতে পারে।
  5. পেশী সংকোচন:
    টিটানাসের ফলে শরীরের পেশী সংকুচিত হতে পারে এবং বিশেষত পেছনের পেশী বা পেটের পেশী শক্ত হয়ে যায়।
  6. মাথাব্যথা এবং খিঁচুনি:
    শিশুদের মাথাব্যথা এবং অস্বাভাবিক খিঁচুনিও হতে পারে, যা টিটানাসের গুরুতর লক্ষণ।

টিটানাস রোগের কারণ:

টিটানাস Clostridium tetani নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট হয়। এই ব্যাকটেরিয়া মাটির মধ্যে এবং কিছু পশুর মল-মূত্রে থাকতে পারে। সাধারণত, এই ব্যাকটেরিয়া খোলামেলা ক্ষত বা আঘাতের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এবং সেখানে টক্সিন উৎপন্ন করে। টক্সিন স্নায়ুতন্ত্রে প্রবাহিত হয়ে পেশীতে সংকোচন বা শক্তি সৃষ্টি করে, যার ফলে শিশু পেশী শক্ত হয়ে যায় এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।

টিটানাসের প্রতিরোধ:

  1. টিটানাস টিকা (Tetanus Vaccine):
    টিটানাস প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল টিটানাস টিকা
    এই টিকা সাধারণত শিশুকে DTP (ডিপথেরিয়া, টিটানাস, এবং পেরটুসিস) টিকার অংশ হিসেবে দেওয়া হয়। সাধারণত, প্রথম ডোজ ২ মাস বয়সে দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে ৪, ৬ এবং ১৮ মাস বয়সে আরও ডোজ দেওয়া হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য টেটানাস বুস্টার টিকা প্রতি ১০ বছরে একবার নেওয়া উচিত।
  2. ক্ষত পরিষ্কার রাখা:
    যদি শিশু কোনও ক্ষত বা আঘাত পায়, তবে তা পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখা অত্যন্ত জরুরি। ক্ষত পরিষ্কার করার জন্য সাবান ও পানি ব্যবহার করতে হবে এবং ক্ষতস্থানে জীবাণুনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
  3. কোভের ক্ষত (Contaminated Wound) থেকে সুরক্ষা:
    ক্ষতস্থানে কোনও ধরনের মাটির সংস্পর্শ এড়াতে হবে। বিশেষ করে যদি শিশুর ক্ষত মাটি বা মল-মূত্রের সংস্পর্শে আসে, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
  4. স্বাস্থ্যকর পরিবেশ:
    শিশুদের পরিচ্ছন্ন পরিবেশে রাখা উচিত, যাতে আঘাতের ফলে টিটানাস হওয়ার ঝুঁকি কমে।

টিটানাস রোগের প্রতিকার:

  1. টিটানাস ইমিউনোগ্লোবুলিন (Tetanus Immunoglobulin):
    টিটানাসের গুরুতর প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসক টিটানাস ইমিউনোগ্লোবুলিন (TIG) প্রয়োগ করতে পারেন, যা ব্যাকটেরিয়ার টক্সিনের প্রভাব কমাতে সাহায্য করে।
  2. অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার:
    টিটানাস সংক্রমণের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হতে পারে, বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধে।
  3. পেশী শিথিলকরণ (Muscle Relaxants):
    পেশী সংকোচন এবং শক্তি কমানোর জন্য পেশী শিথিলকরণ ঔষধ দেওয়া যেতে পারে, যা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দেওয়া হবে।
  4. ভেন্টিলেটরি সাপোর্ট:
    যদি শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা সৃষ্টি হয়, তবে চিকিৎসক ভেন্টিলেটরি সাপোর্ট বা শ্বাস সহায়ক যন্ত্র ব্যবহার করতে পারেন।

টিটানাসের চিকিৎসা:

টিটানাসের জন্য চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি এবং দ্রুত শুরু করা উচিত। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থা নেওয়া হয়:

  1. টিটানাস ইমিউনোগ্লোবুলিন (TIG):
    টিটানাস টক্সিনের প্রভাব কমানোর জন্য ইমিউনোগ্লোবুলিন দেওয়া হয়।
  2. অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি:
    সংক্রমণ রোধে এবং টিটানাস ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার ঠেকাতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়।
  3. সাংকেতিক থেরাপি (Supportive Care):
    শিশুকে চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি করে পেশী শিথিলকরণ, অক্সিজেন সাপোর্ট এবং অন্যান্য সহায়ক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
  4. ভেন্টিলেটর সাপোর্ট:
    গুরুতর শ্বাসকষ্ট বা শ্বাস নেবার সমস্যা দেখা দিলে, ভেন্টিলেটর দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের সহায়তা প্রদান করা হয়।

টিটানাসের পরামর্শ:

  1. টিকা নেওয়ার জন্য সময়মতো ভ্যাকসিন গ্রহণ:
    শিশুকে টিটানাস টিকা নেওয়ার পরামর্শ দিন। শিশুর বয়স অনুযায়ী নিয়মিত টিকা দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  2. ক্ষতস্থানে যত্ন নেওয়া:
    শিশুদের ক্ষত হলে তা পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত করা উচিত। তাতে আঘাত থেকে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়।
  3. ক্ষত শনাক্ত এবং চিকিৎসা:
    শিশুর যেকোনো ক্ষত বা আঘাত হলে তা যথাসম্ভব দ্রুত চিকিৎসককে দেখান। বিশেষ করে যদি আঘাতটি মাটির সংস্পর্শে আসে।
  4. টিটানাসের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ:
    যদি শিশুর মধ্যে টিটানাসের কোনো লক্ষণ দেখা দেয় (যেমন পেশী শক্ত হয়ে যাওয়া বা শ্বাসকষ্ট), তবে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।

টিটানাসের সতর্কতা:

  1. টিকা না নেওয়া:
    টিটানাস টিকা গ্রহণ না করলে শিশুদের মধ্যে টিটানাস হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সুতরাং, নিয়মিত টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করা উচিত।
  2. ক্ষতের সংস্পর্শে না আসা:
    শিশুকে ক্ষতস্থানে মাটি বা মল-মূত্রের সংস্পর্শে আসা থেকে বিরত রাখুন। যদি কোনো খোলামেলা ক্ষত হয়, তবে তা দ্রুত পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
  3. ভ্যাকসিন নেয়ার পরামর্শ না নেওয়া:
    যদি কোনো কারণে শিশুর টিকা নেওয়া না হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তা নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।

উপসংহার:

টিটানাস একটি গুরুতর এবং প্রাণঘাতী রোগ, তবে এটি টিটানাস টিকা দ্বারা সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। শিশুদের উপযুক্ত সময়ে টিকা দেওয়ার পাশাপাশি, আঘাতের ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং ক্ষত পরিষ্কার রাখা প্রয়োজন। টিটানাসের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে, যাতে রোগটির প্রভাব কমানো যায়।

ঘোষণা: এই ওয়েবসাইটে (Bangla Articles) প্রকাশিত সকল লেখনি লেখক ও ওয়েব এডমিন মুহাম্মাদ আল-আমিন খান কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। Bangla Articles এর কোনো লেখনি থেকে সম্পূর্ণ অথবা আংশিক কপি করে সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্য কোনো ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা যাবে না। কোনো লেখনি ভালো লাগলে ও প্রয়োজনীয় মনে হলে এই ওয়েবসাইট থেকেই তা পড়তে পারেন অথবা ওয়েব লিংক শেয়ার করতে পারেন। গুগল সার্চ থেকে দেখা গেছে যে- বহু লেখনি কতিপয় দুষ্কৃতিকারী নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন, যা সম্পূর্ণরূপে কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন। ভবিষ্যতে আবারও এমনটি হলে প্রথমত গুগলের কাছে রিপোর্ট করা হবে ও দ্বিতীয়ত তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কপিরাইট আইনের আওতায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সাথে সকলের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে- Bangla Articles এ প্রকাশিত কোনো লেখনি আপনার ভালো না-ও লাগতে পারে, প্রয়োজনে আপনি এর সমালোচনা কমেন্টের মাধ্যমে করতে পারেন। বাক স্বাধীনতা, চিন্তার বহিঃপ্রকাশ করার অধিকার ও লেখালেখি করার অভ্যাসের জায়গা থেকে লেখক যা ইচ্ছা তাই লিখতে পারেন। তবে তিনি তার যেকোনো লেখনির ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন যাতে করে শালীনতা বজায় রাখা যায় এবং অন্যের ধর্মীয় অনুভূতি, মূল্যবোধ ও অধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা যায়। - মুহাম্মাদ আল-আমিন খান, লেখক ও ওয়েব এডমিন, Bangla Articles

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)
To Top